‘শবেবরাত এর রাত-চারশ’ বছর বিরামহীন ইবাদতের সমান’
ড. শহিদুল্লাহ : ‘শবেবরাত এর রাত-চারশ’ বছর বিরামহীন ইবাদতের সমান’। পবিত্র রজনী শবে বরাতের তাৎপর্য, ফজিলত কি হতে পারে এবং আমাদের করণীয় আমলসমূহ কি ধরণের হওয়া উচিৎ এসবের আলোকে তৈরি করা হয়েছে এ বিশেষ প্রতিবেদন।
পবিত্রগ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সিয়ামব্রত পালনের পবিত্র মাস রমজানের প্রাক্কালে মহান প্রভুর কাছে মিনতি করে বলতেন- ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রাজাবা ওয়া শাবান ওয়া বালি্লগনা রামাদান’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর রজব এবং শাবানের বরকত দান করো এবং আমাদের মাহে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।
মহানবীর (সা.) উল্লেখিত প্রার্থনাবাণীতে শাবান মাসের যে বরকত নিহিত রয়েছে, তা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আমরা শাবানের সেই বরকতময় অবস্থার ইঙ্গিত পাই। সুরা দুখানের তিন থেকে পাঁচ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- ‘নিশ্চয়ই আমি এক বরকতময় রাতে কোরআন অবতীর্ণ করেছি। নিশ্চিতভাবে আমিই ভয় প্রদর্শনকারী। এ রাতে আমার পক্ষ হতে আমারই নির্দেশে সব প্রজ্ঞাময় কর্মের ফয়সালা হয়ে থাকে। আর অবশ্যই আমি সবকিছুর প্রেরণকারী।’
পবিত্র কোরআনের বিশ্লেষক ও ধর্মীয় প্রাজ্ঞজনের একটি বড় অংশের মতে, কোরআনে কারিমে উলি্লখিত ‘বরকতময় রাত’ বলতে আরবি অষ্টম মাস শাবানের মধ্য রজনী তথা শবেবরাতকেই বোঝানো হয়েছে।
মানুষের ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, লাভ-ক্ষতি, সম্মান-অসম্মান, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিসহ সবকিছুই আয়াতে উল্লেখিত ‘সব প্রজ্ঞাময় কর্মের ফয়সালা’র অন্তর্ভুক্ত, যা লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান তথা শাবানের মধ্যরাতে সম্পন্ন হয় বলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশ্লেষকরা মত ব্যক্ত করেছেন। আর সে কারণে এই রাতকে শবেবরাত বা ভাগ্যরজনী হিসেবেও দেখা হয়। পবিত্র শাবান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার পেছনেও শবেবরাতের মহিমা ও তাৎপর্য অপরিসীম।
ইতিহাসের স্বতঃসিদ্ধ তথ্য হচ্ছে, মহানবীর (সা.) পূর্বেকার সমস্ত নবী-রাসূলের উম্মতরা দীর্ঘ হায়াত পেয়েছেন। ফলে বহুদিন পর্যন্ত নেক আমল তথা ভালো কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ তারা অর্জন করেন। কিন্তু আখেরি জমানার পয়গম্বর মুহাম্মদের (সা.) উম্মতের ক্ষেত্রে বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের আয়ুষ্কাল পূর্ববর্তীদের তুলনায় খুবই সীমিত। এই স্বল্পায়ু উম্মতের অধিকতর পুণ্য অর্জনের জন্য যেসব দিবস ও রজনী মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসেবে এসেছে, পবিত্র শবেবরাত তারই অন্যতম এক উপলক্ষ; যে রাতে বন্দেগি-উপাসনার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে একটি ঘটনার অবতারণা করা যেতে পারে। হজরত ঈসার (আ.) সময়ে সংঘটিত ঘটনাটি শবেবরাতের মহিমাকে আরও বোলন্দ মর্যাদা এনে দিয়েছে। নবী ঈসা (আ.) একদা পথ অতিক্রম করছিলেন। পথিমধ্যে তিনি একটা বৃহদাকারের প্রস্তর প্রত্যক্ষ করলেন। পাথরটি অভিনব সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছিল। ঈসা (আ.) পাথরের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে এর চারদিক প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন।
অকস্মাৎ নবীর প্রতি ঐশ্বরিক বাণীর আওয়াজ ভেসে এলো- হে ঈসা (আ.), একটা পাথর দেখে তার সৌন্দর্যে আশ্চর্যান্বিত হয়ে চতুর্দিকে ঘোরাঘুরি করছো, তুমি কি পাথরের ভেতরকার আরও আশ্চর্যকর কিছু দেখতে চাও?
নবীর আগ্রহ বেড়ে গেল। তিনি দেখতে চাইলেন। হঠাৎ করেই পাথরটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল এবং পাথরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন শ্বেত-শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত তাপস; হাতে তসবিহ এবং মুখে তার আল্লাহর গুণকীর্তন। বিস্ময়-পুরুষ নবী ঈসাকে (আ.) সালাম বললেন এবং তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
ঈসা (আ.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতদিন এই পাথরের ভেতর ইবাদত করছেন? রহস্য-পুরুষের সাবলীল জবাব, চারশ’ বছর। নবী আরও বিস্মিত হলেন। বললেন- চারশ’ বছর পাথরের ভেতর! কী খেলেন আর কীভাবেই-বা বেঁচে থাকলেন?
বিস্ময়-অলি নবীকে দেখালেন, ওই যে পাথরের ভেতরেই রয়েছে একটি খেজুর গাছ। সেখানে আমার চাহিদা অনুযায়ী নিত্যদিন সুস্বাদু খেজুর উৎপাদিত হতো, আমি খেতাম, জীবনধারণ করতাম আর মহান আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকতাম। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ চারশ’ বছর। নবীর কাছে বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।
ঈসা (আ.) ভাবলেন, যে লোক দুনিয়ার ফেতনা-ফ্যাসাদে না জড়িয়ে একটি স্বর্গীয় অলৌকিক পাথরে বিশেষ ব্যবস্থায় দীর্ঘ চারশ’ বছর রিয়াহীন ইবাদতে নিমগ্ন থেকেছেন, তিনি হয়তো সবচেয়ে বেশি পুণ্যবান বান্দা হিসেবে আল্লাহর দরবারে পরিগণিত হবেন।
কিন্তু নবী ঈসার (আ.) এই ভাবনার ফলে আবারও সেই ঐশ্বরিক-বাণী উচ্চকিত হলো, ‘আমার আখেরি জমানার মহান পয়গম্বরের অনুসারী হয়ে শাবান মাসের মধ্যরাতে (শবে বরাত) যে ব্যক্তি ইবাদত করবে, সে চারশ’ বছর বিরামহীন ও রিয়াহীন ইবাদতকারী এই নিষ্কলুষ রহস্য-তাপসের চেয়েও অধিক পুণ্যবান বান্দা হিসেবে আমার কাছে পরিগণিত হবে। শবেবরাতের প্রকৃত তাৎপর্য এই ঘটনার মধ্য দিয়েই অনুধাবন করা যায়।
অনন্য মহিমা আর অনবদ্য বৈশিষ্ট্যে মোড়ানো এই পবিত্র শবে বরাত। এ রাত দোয়া-প্রার্থনা কবুলের রাত, এ রাত পাপাচার থেকে মুক্তি অর্জনের রাত, এ রাত বান্দার তওবা-অনুশোচনা মঞ্জুর হওয়ার রাত, এ রাত যাবতীয় বালা-মুসিবত তথা বিপদ-আপদ থেকে উদ্ধারের রাত এবং এ রাত প্রতিটি মানুষের আগামী এক বছরের ভাগ্য নির্ধারণের গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এক রাত।
রজব মাসের প্রথম রাত, দুই ঈদের রাত এবং শবেকদরের রাতসহ বান্দার দোয়া কবুল হয় যে পাঁচটি পবিত্র রাতে তার অন্যতম হলো এই শবে বরাত।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, শবে বরাতের জন্য মহানবীর (সা.) নির্দেশনা হলো, দিবসে সিয়ামব্রত পালন আর রাতে আল্লাহর ইবাদত করা। কেননা, এ রাতে মহান আল্লাহর এক অপূর্ব রহমতের বারিধারা বর্ষিত হয়। দুনিয়ার একেবারে কাছাকাছি এসে মহান বিশ্বনিয়ন্তা ঘোষণা করতে থাকেন- কে আছ গুনাহগার, আমি তোমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করে দেব। কে আছ অন্নপ্রার্থী, আমি তোমার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেব। কে আছ বিপদগ্রস্ত, আমি তোমাকে বিপদমুক্ত করব। এভাবেই পূর্বদিগন্তে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সাফল্য ও মুক্তি লাভের ঘোষণা অব্যাহত থাকে।
শবে বরাতে অসংখ্য ফেরেশতার পৃথিবীতে অবতরণ, ইবাদতকারীদের পর্যবেক্ষণ, শান্তি সুবাতাস প্রবাহিতকরণ এবং বিশেষ এ রাতকে জীবন্ত রাখার ব্যাপারে মহানবীর (সা.) নির্দেশনা শবে বরাতকে এক অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে। এ রাতের ব্যাপারে নবীপত্নী হজরত আয়েশা সিদ্দিকার দেওয়া তথ্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য।
তিনি বলেন, আমি রাসূলে পাকসহ একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন আমার ঘুম ভাঙল দেখি রাসূল আমার পাশে নেই। খুঁজতে গিয়ে তাকে জান্নাতুল বাকিস্ফ কবরস্থানে পেলাম। আমি শুনতে পাচ্ছি নবীজি বলছেন, শবে বরাতে মহান আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং আরবের কাল্ব উপজাতির ছাগলের পশমতুল্য বা তার চেয়েও বেশিসংখ্যক মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য মওকুফ করে দেন। উল্লেখ্য, এ সম্প্রদায়ের অজস্র ছাগলপাল ছিল; যাদের পশমসংখ্যা অগণিত।
আল্লাহর বান্দাদের কাছে প্রতিটি রাতই ইবাদতের এবং প্রতিটি ক্ষণই মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ। আবহমানকাল থেকে চলে আসা এসব পবিত্র দিবস ও রজনী আজ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে শবে বরাতে রাতভর ইবাদতে মশগুল থাকা, রাত জাগরণ ও বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা- এসবই এখন আমাদের উৎসবের এবং উপভোগের অনুষঙ্গ হয়ে গেছে।
খোদাভীরুতা, এস্তেগফার, দোয়া-প্রার্থনা, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত, কবর জিয়ারত, আত্মীয়ের সানি্নধ্য- এসবের কোনোটাই নেতিবাচক কাজ নয়; বরং ব্যস্ত দিনপঞ্জিতে আর পার্থিব কোলাহলের মাঝে বিশেষ উপলক্ষে এসব মানবিক, ধর্মীয় ও মূল্যবোধগত কর্ম সম্পন্নকরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের মানসিকতা আরও ইতিবাচক করে তোলার এক চমৎকার সুযোগ অর্জিত হয়।
তাই শবে বরাত নিয়ে কোনো ধরনের এখতেলাফ বা মতদ্বৈধতা-মতপার্থক্য সৃষ্টি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় এবং এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে সাধারণ মানুষকে এ রাতের ইবাদত থেকে নিরুৎসাহিত করার মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকার কথা নয়। পাশাপাশি এ রাতকে ঘিরে কারও বাড়াবাড়ি করা, আতশবাজি, পটকা ফোটানোসহ জনজীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে এমন কিছু করাও সঙ্গত বা প্রত্যাশিত নয়।
বরং ইসলাম ও এর শরিয়তের গণ্ডির ভেতরে থেকেই পুণ্যার্জনের ব্রত নিয়ে মহিমান্বিত রজনী শবে বরাতের প্রকৃত কল্যাণ হাসিল করা বাঞ্ছনীয় এবং উদার, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িকতার মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মানবজীবনে এ বিশেষ রাতের সর্বোচ্চ তাৎপর্য কাজে লাগানোই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।