লোকসানেও ন্যাশনাল ব্যাংকে রনের চালাকি
শফিক রহমান : ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন হক শিকদারের নানা চালাকি ও জালিয়াতি নিয়ে তোলপাড় চলছে ব্যাংকটিতে! অভিযোগ করা হয়েছে রনের চালাকির কারণে ৩৯তম এজিএমে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে হোসাফ গ্রুপের মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেনকে পরিচালক পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অথচ ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন, পরে যুক্ত হন তাঁর ছেলে মাবরুর হোসেন।
দেশের বেসরকারি খাতের এক সময়ের নাম ডাক সম্পন্ন ন্যাশনাল ব্যাংক এখন যেন বেহাল অবস্থায়! বাংলাদেশ ব্যাংক (বি-বি) এর একটি চিঠি তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের কোন সভায় আপাতত যোগ দিতে পারবেন না পরিচালক রন হক সিকদার। তিনি ব্যাংকটির পরিচালক পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য। বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে তাঁকে এসব সভায় যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিপুল পরিমাণ টাকা লোকসান দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক। গত বছরের বিভিন্ন প্রান্তিকে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ার তথ্য প্রকাশ করেছিল। গত বছর ব্যাংকটি ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ফলে ২০২১ সালের মতো গত বছরের জন্যও শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার সুপারিশ করেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
দেশের অনেক ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও প্রকৃত তথ্য প্রকাশ হয় না বললেই চলে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের এই ব্যাংক বড় ধরনের লোকসানের তথ্য প্রকাশ করেছে। এর আগে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে একক বছরে এত লোকসানের খবর মেলেনি। এর মাধ্যমে দেশের দুরাবস্থায় থাকা ব্যাংকের বাস্তব চিত্র বের হতে শুরু করেছে বলে খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ২০২০ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ও ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। ২০২১ সালে আমানত ও ঋণ বেড়ে হয় যথাক্রমে ৪৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ও ৪৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে আমানত ও ঋণ দুটিই কমে গেছে। ২০২২ সাল শেষে আমানত কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা ও ঋণ কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ‘অযাচিত হস্তক্ষেপ ও প্রতি প্রান্তিকে লোকসানের তথ্য প্রকাশ করায়’ অনেকে আতঙ্কিত হয়ে আমানত সরিয়ে নিয়েছেন। এর প্রভাবে দৈনন্দিন কাজ চালাতে ব্যাংকটিকে অন্য ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করতে হয়েছে। অন্যদিকে ঋণের টাকাও আদায় হচ্ছে না। এর ফলে খরচ বাড়িয়ে লোকসান হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের কোন সভায় আপাতত যোগ দিতে পারবেন না পরিচালক রন হক সিকদার। তিনি ব্যাংকটির পরিচালক পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য। বাংলাদেশ ব্যাংক এক চিঠিতে তাঁকে এসব সভায় যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে।
গত ২৬ জুলাই দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের ৩৯তম বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) পরিচালক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত রন হক সিকদারের পরিচালক নিযুক্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। এই অনুমোদন না দেওয়া পর্যন্ত তিনি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, নির্বাহী কমিটি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
গত বছরের ২৫ আগস্ট ব্যাংকের ৩৯তম এজিএম অনুষ্ঠিত হয়। এজিএমের আগে অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় নিয়ম অনুযায়ী তৎকালীন পরিচালক ও হোসাফ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন ও পরিচালক মাবরুর হোসেন এবং রন হক সিকদার পদত্যাগ করেন। পরের দিন এজিএমে ভোটে বাদ পড়েন মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেন। তবে শেয়ারধারীদের ভোটে নির্বাচিত হয় রন হক সিকদার। আইন অনুযায়ী এজিএমে অনুমোদনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো তাতে অনুমোদন দেয়নি।
এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেনকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, গত বছরের ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত ব্যাংকের এজিএমে নির্বাচিত ও পুনর্নির্বাচিত পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। এ জন্য তাঁদের সব ধরনের নথি দ্রুত জমা দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ন্যাশনাল ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, ৩৯তম এজিএমে ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাবরুর হোসেনকে পরিচালক পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পরিচালক ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন, পরে যুক্ত হন তাঁর ছেলে মাবরুর হোসেন।
ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, গত বছরের ২৫ আগস্ট এজিএম শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে ব্যাংকের শেয়ারধারীদের অনলাইনে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে অংশ নেন ৭৫৪ জন শেয়ারধারী। অনলাইন ভোটে ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়ে আবার পরিচালক নির্বাচিত হন রন হক সিকদার। আর মোয়াজ্জেম হোসেন ও পরিচালক মাবরুর হোসেনকে শেয়ারধারীরা প্রত্যাখ্যান করেন বলে জানান ন্যাশনাল ব্যাংকের কোম্পানি সচিব কায়সার রশিদ। এজিএমে তিনি আরও জানান, ব্যাংকটি ২০২১ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না এবং এতে ৯৫ শতাংশ শেয়ারধারী সমর্থন দিয়েছেন।
তবে প্রশ্ন উঠছে অনলাইন ভোটের ব্যবস্থাপনা নিয়ে। কারণ, ৯৫ শতাংশ শেয়ারধারী কখনোই লভ্যাংশ না দেওয়ার প্রস্তাবে সমর্থন দিতে পারেন না বলে মনে করেন ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যাংকটির একাধিক সূত্র বলছে, শেয়ারধারীদের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) আইডি ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে অনলাইনে ভোট দেওয়া হয়।
ব্যাংকটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার, পরিচালক পারভীন হক সিকদার, রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার। তাঁরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। এ ছাড়া পরিচালক হিসেবে আছেন জাকারিয়া তাহের ও খলিলুর রহমান। পাশাপাশি স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে আছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মুরশিদ কুলী খান, সিকদার গ্রুপের কর্মকর্তা নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা শফিকুর রহমান।
নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চারজনের পরিবর্তে তিনজন পরিচালক থাকা যাবে। ফলে একজন পরিচালককে এমনিতেও সরে দাঁড়াতে হবে।
প্রসঙ্গত, ন্যাশনাল ব্যাংক প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক। উদ্যোক্তাদের ঋণ জালিয়াতির কারণে ব্যাংকটি এখন ঝুঁকছে। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ২৫ শতাংশই খেলাপি। ব্যাংকটি গত বছরে ৩ হাজার ২৬০ কোটি লোকসান করে। ফলে শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিচ্ছে না।