লুটপাটে আগুন গাজী টায়ারে
গাজী-দাদা বাহিনীর ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ-লুটপাটকারী ৯২ নিখোঁজ-
নারায়নগঞ্জ ও রুপগঞ্জ প্রতিনিধি : পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর গাজী গ্রুপের হৃৎপিন্ড গাজী টায়ার পুড়িয়ে দিয়েছে লুটপাটকারী বিক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী। শুধু পুড়িয়েই ক্ষান্ত হননি তারা; লুটপাট করতে গিয়ে নিজেরাও আগুনের তোপে পড়ে নিখোঁজ হয়েছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে গাজী-দাদা বাহিনী রুপগঞ্জে যে এাসের রাজত্ব, সন্ত্রাস, লুটপাট, সম্পত্তি দখল এর মত অরাজকতা কায়েম করেছিল গাজী টায়ার জ্বালিয়ে দেয়া তারই বর্হিপ্রকাশ।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসীতে লুটপাটের পর আগুন দেয়া গাজী টায়ারসের কারখানায় সোমবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত আগুন জলছিল। গাজী গ্রুপের এই টায়ার তৈরির কারখানায় দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনায় লুটপাট করতে আসা ৯২ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেছেন পরিবারের সদস্যরা। সোমবার ২৬ আগস্ট বেলা সোয়া ৪টা পর্যন্ত ৯২ জন নিখোঁজের তালিকা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম।
তিনি দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, স্বজনরা যারা দাবি করছেন যে তাদের পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছেন, যারা গতরাতে লুটপাটের সময় এই কারখানায় এসেছিলেন। আমরা তাদের একটি খসড়া তালিকা করেছি। এ মুহূর্তে তা যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। স্বজনরা যারা দাবি করছেন তাদের নাম, ঠিকানা লিখে রাখছি। এখন পর্যন্ত এ তালিকা ৯২ জন পর্যন্ত হয়েছে।
নিখোঁজ স্বজনদের দাবি, গতকাল রোববার রাতে গাজী টায়ারসে লুটপাট চলাকালীন তাদের নিখোঁজ সদস্যরা কারখানাটির ভেতরে ছিলেন। রাতভর তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। মোবাইল ফোনও বন্ধ। কারখানাটির ছয়তলা একটি ভবনে বেলা তিনটায়ও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট।
আগুন জ্বলতে থাকা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন মনি আক্তার নামে এক নারী৷ কারখানাটির অদূরে কলাবাগ এলাকার বাসিন্দা মনি বলেন, তার রাজমিস্ত্রি স্বামী মো. রাশেদ গতরাত সাড়ে ৮টার দিকে কারখানাটিতে এসেছিলেন। সাথে ছিলেন ওই এলাকারই আরেক বাসিন্দা। রাতে রাশেদ বাসায় না ফেরায় মোবাইলে কল দিলেও তা বন্ধ পান। মনি বলেন, সারারাত ধরে আমার বাচ্চার আব্বারে খুঁজতেছি, পাই নাই। যার সাথে আসছিল তারে আমি চিনি না। আমি এখন কী করমু বলেই কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বসে পড়েন এ নারী।
নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন, একটি সিমেন্ট কারখানার কর্মী আব্দুর রহমান (৩০), ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. সুজন (২৮), তার বোন মাফিয়া বেগম (৩০), বোনের স্বামী মো. রতন (৩৫), বড়ালু এলাকার রাজমিস্ত্রি হাসান আলী (৩২), তার দুই বন্ধু অহিদ (৩২) এবং রুবেল (৩০) নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাদের স্বজনরা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন।
রোববার দিবাগত রাত ৯টার দিকে আগুন দেওয়ার এই ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম৷আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট রাত থেকে কাজ করলেও সোমবার সকাল ১২টা পর্যন্তও তা পুরোপুরি নেভানো যায়নি৷ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন কারখানাটিতে প্রচুর প্ল্যাস্টিকজাতীয় কাঁচামাল ও দাহ্য বস্তু থাকার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে।
এর আগে গতকাল ভোররাতেই রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী৷ বিকেলে একদল দুর্বৃত্ত গাজীর টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটিতে হামলা চালায়, লুটপাট শুরু করে৷সাইফুল ইসলাম বলেন, বিকেলে দুটি গ্রুপে কয়েক শ লোক রূপসীর কারখানায় ঢুকে পড়ে৷ আমাদের কর্মীদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না৷ লুটপাটের পর রাত নয়টার দিকে কারখানার একাধিক ভবনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়৷ ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট এলেও তারা আগুন নেভাতে পারছেন না৷কারখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ হামলা শুরুর পর পুলিশে ফোন দিয়েও সহযোগিতা পাননি তারা।
সাইফুল বলেন, হামলা শুরুর পর থানাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিলে সেনাবাহিনীর একটি টিম আসে গেটের সামনে৷ কিন্তু ১০ মিনিটের বেশি তারা দাঁড়াননি৷ পরে আগুন দেওবার পর ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসে৷’ছয়তলা একটি ভবনের নিচে যখন আগুন দেয়া হয় তখন লুটপাটকারীদের কয়েকজন ভবনটির ওপরে ছিলেন৷ কয়েকজন দাবি করছেন, তাদের স্বজনরা ভবনে আটকা পড়েছেন, যোগ করেন গাজী গ্রুপের এই কর্মকর্তা৷তবে এখন পর্যন্ত হতাহতের নিশ্চিত কোনো খবর পাওয়া যায়নি৷
এ বিষয়ে এক ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল রেজাউল করিম বলেন, খবর পেয়ে রাত ১১টা ৪০ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস৷ এটি একটি টায়ার তৈরির ফ্যাক্টরি৷ আগুন পুরো ফ্যাক্টরিতে ছড়িয়ে পড়ে৷ টায়ার, টায়ার তৈরির কাঁচামাল রাবার ও প্লাস্টিকজাতীয় দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে৷
এই মুহূর্তে সেখানে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ করছে জানিয়ে রেজাউল করিম বলেন, ‘ভবনে আটকে পড়া ১৪ জনকে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি৷ তারা এ কারখানার কর্মী নন, মূলত কারখানাটির মালামাল সরিয়ে নিতে তারা এসেছিলেন৷ আরও কেউ ভবনে আটকা পড়েছেন কি না তা আগুন নেভানোর আগে বলা যাচ্ছে না৷’
এর আগে গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গাজীর রূপসী ও কর্ণগোপের দুটি কারখানায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে৷