রুপের আড়ালে পরকীয়া’য় লুকিয়ে ছিল খুনী স্ত্রী মনুয়া
ডেস্ক রিপার্টার দীনা করিম : রুপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল খুনী স্ত্রী মনুয়া! ওপরের ছবিটা দেখে কে বিশ্বাস করবে যে, এই মেয়েই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে খুন করিয়েছে তাঁর স্বামীকে! এই মিশুকে, হাসিখুশি মুখের আড়ালে এমন নৃশংস খুনের ছক কে আঁচ করতে পেরেছিল!
গত বছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ভিডিওয় মনুয়া-অনুপমের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত দেখার পর তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা বিস্মিত! স্বামীর প্রতি এতোটা ক্ষোভ কি তখন থেকেই হাসির আড়ালেই লুকিয়ে রেখেছিল মনুয়া? নাকি পরে বদলে গিয়েছিল মন? এমনই নানা প্রশ্নের জালে এখন বেশ জটিল হয়ে উঠেছে অনুপম খুনের রহস্য।
দীর্ঘ ছ’ সাত বছরের প্রেম। তারপর বিয়ে। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশেরও মত, স্ত্রী মনুয়াকে অসম্ভব ভালবাসতেন অনুপম। বিয়ের পরেই স্ত্রীকে নিয়ে ব্যাঙ্কক, পটায়ায় ঘুরতে যান। বাংলাদেশে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েও বড় করে ‘রিসেপশন’ করেন। খুনের মাস দুয়েক আগেও লক্ষাধিক টাকা খরচ করে প্রথম বিবাহবাষির্কী পালন করেছিলেন মনুয়া-অনুপম।
মনুয়া-অনুপমের পুরনো যে সব ভিডিও পুলিশ পেয়েছে, সেখানেও অনুপমকে ‘পারফেক্ট হাজব্যান্ড’ বলতে শোনা গিয়েছে মনুয়াকে। দু’জনের পুরনো ভিডিও দেখে পুলিশও বিশ্বাস করতে পারছে না যে এই রকম একটা সম্পর্কের এমন একটা পরিণতি হতে পারে!
১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬-এ অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে দত্তপুকুরে পিকনিকে গিয়েছিলেন মনুয়া-অনুপম। সেখানেও সকলের সামনে একে অপরের সম্পর্কে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন দু’জনেই। এই ‘পার্ফেক্ট’ সম্পর্কের এমন চরম পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।
খুনী মনুয়ার অন্তরালে-
স্ত্রী মনুয়ার সঙ্গে ব্যাঙ্কে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন অনুপম সিংহ। সেই অ্যাকাউন্টের টাকা দিয়েই ‘সুপারি কিলার’ লাগিয়ে অনুপমকে খুন করতে চেয়েছিল মনুয়া। কিন্তু প্রেমিক অজিত রায়ের সঙ্গে আলোচনার পরে সেই টাকাটাও নষ্ট করতে চায়নি সে। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় মঙ্গলবার বলেন, ‘‘নিজেদের মধ্যে আলোচনার পরেই সুপারি কিলারের পরিকল্পনা ছেড়ে অনুপমকে খুনের ছক করে দু’জন।’’
অনুতাপ তো দূর, জেরায় অনুপমের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছে মনুয়া। পুলিশের দাবি, জেরায় মনুয়া বলেছে, সে পড়াশোনা, নাচ আর চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু অনুপমের সঙ্গে আলাপের পরেই তাঁকে বিয়ে করতে চাপ দিচ্ছিলেন বাবা-মা।
তাঁরা বাংলাদেশে অনুপমের বাড়ি গিয়ে বিয়ে পাকাও করে আসেন। মনুয়া রাজি না হওয়ায় তাঁর স্থানীয় এক কাউন্সিলরের কাছে মনুয়াকে নিয়ে যান। সবার চাপেই সে বিয়েতে রাজি হয়। মনুয়া আরও জানিয়েছে, অনুপম সব সময়ে নিজের কেরিয়ার ও টাকাপয়সার পিছনে ছুটতেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কে মনুয়া কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে রাগারাগি করতেন।
মনুয়ার অভিযোগ, কিছু হলেই সব সময়ে তাঁর বাবা-মাকে ফোন করে মনুয়ার নামে অভিযোগ জানাতেন অনুপম। মনুয়ার দাবি, সে পুরসভায় চাকরি পাওয়ার পরে কাজ ছাড়ার জন্য জোর করতেন অনুপম। সন্তান নিতেও চাপ দিতেন। মনুয়া তার জন্য আরও সময় চেয়েছিল। এ সবের জেরে মনুয়া এক দিন রেগে বাড়ি ছেড়ে চলেও যায়। মা-বাবা আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
তবে মনুয়া-অনুপমের পুরনো যে সব ভিডিও পুলিশ পেয়েছে, সেখানে অনুপমের নামে ‘পারফেক্ট হাজব্যান্ড’ এবং আরও প্রশস্তিই শোনা গিয়েছে মনুয়ার মুখে। পুলিশ জানিয়েছে, এ সবের মধ্যেই গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মনুয়ার জীবনে আসে অজিত। ঘনিষ্ঠতা হয়। তার পরে সুপারি কিলার দিয়ে অনুপমকে খুনের ছক কষা হলেও পরে অজিতই খুন করবে বলে ঠিক হয়। তার পরে টাকাপয়সা নিয়ে সংসার পাতবে।
খুনের পরে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দেয় মনুয়া। কারণ হিসেবে সে এক বার বলেছিল, পাপবোধ থেকে। অন্য বার জানায়, রাস্তা ‘সাফ’ হয়েছে বলে। অজিতও জানিয়েছে, খুনের পরদিন দক্ষিণেশ্বরে সে-ও গিয়েছিল।
অজিত জানিয়েছে, খুনের পরে তার জামাকাপড় রক্তে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। অনুপমের ঘরের বেসিনে রক্ত ধুয়ে সে মনুয়ার সঙ্গে দেখা করে অশোকনগরের বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু উত্তেজনায় ওই রাতেই শোভাবাজারে চলে আসে। সেখানে মদ খায়। রাত কাটায় যৌনপল্লিতে। সকালে দক্ষিণেশ্বরে যায়। তবে পুজো দিতে নয়, রক্তে মাখা জামাকাপড় গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে।
মনুয়া এমন? বিশ্বাস হচ্ছে না মামার-
জমাট রক্তের মধ্যে ক্ষতবিক্ষত এক দেহ। মেঝের উপরে পড়ে থাকা শরীরের পা দু’টি দেখেই জামাইবাবুকে চিনতে পেরেছিলেন তিনি। দেখেই ছিটকে বেরিয়ে আসেন। শরীর খারাপ লাগতে থাকে। কোনও মতে বাড়ি ও পাড়ার লোকেদের খুনের খবরটা দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার এই প্রথম সংবাদমাধ্যমের কাছে সব কথা খুলে বললেন সবসাচী দাস ওরফে বুবাই, নিহত অনুপম সিংহের দেহ যিনি প্রথম দেখেছিলেন।
সম্পর্কে মনুয়ার মামা হন বুবাই। কিন্তু বয়সে ছোট বলে মনুয়াকে দিদি ডাকেন। বুবাইয়ের কথায়, ‘‘আমরা দু’জনে হরিহর-আত্মা ছিলাম।’’ বুবাইও নৃত্যশিল্পী। মনুয়ার সঙ্গে বুবাই অনেক নাচের অনুষ্ঠানও করেছেন। খুনের পরে, ধরা পড়ার দু’দিন আগে পর্যন্তও মনুয়াদের বাড়িতে একসঙ্গে কাটিয়েছেন দু’জন। সেই মনুয়ার মধ্যেই যে এমন এক জন অপরাধী লুকিয়ে ছিল, তা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না আতঙ্কিত বুবাই। তাঁর কথায়, ‘‘ওকে দেখে ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি কিছু। অদ্ভূত লাগছে!’’
বুবাইয়ের দাবি, খুনের পরদিন, ৪ মে সকালে তাঁকেই ফোন করেছিল মনুয়া। বুবাই বলেন, ‘‘আমাকে ফোন করে মনুয়া বলে, অনুপমকে ফোনে পাচ্ছি না। বাড়ি গিয়ে আমাকে ফোন করতে বল তো।’’ বুবাইয়ের বাড়ি থেকে অনুপমদের বাড়ি পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ। বুবাই বলেন, ‘‘কলিং বেল বাজাই। ডাকাডাকি করি। কিন্তু সাড়া পাই না। দেখি, গেট খোলা। লোহার দরজাটাও সামান্য ফাঁক করা। ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। মাথা ঘুরতে থাকে। দেখি, সারা শরীরটা পুরো ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।’’
খুনের দিন মনুয়া যখন প্রেমিক অজিত রায়ের সঙ্গে অনুপমের ঘরে কাটাচ্ছিল, তখন মনুয়াকে ফোন করেছিলেন বুবাই। ফোন কেটে দেয় মনুয়া। বুবাই বলে, ‘‘কিছু ক্ষণ পরে ও ফোন করে। বলে, অফিসের মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাড়ি ফিরছি। পরে কথা হবে।’’ এর পরের ফোনটি আসে পরদিন সকালে।
অনুপম যে খুন হয়েছে, সে কথা বুবাইয়ের পরিবারই ফোনে মনুয়ার মাকে জানায়। বুবাইয়ের কথায়, ‘‘খবরটা শোনার পর থেকে মনুয়াদি ভেঙে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছিল। আমরা খুব ভাল বন্ধু বলে আমার বাড়ির লোক ঘটনার পর থেকে ওদের বাড়ি গিয়ে থাকতে বলে।’’ গ্রেফতারের দু’দিন আগে পর্যন্ত দিন দশেক ধরে মনুয়ার ছায়াসঙ্গী ছিলেন বুবাই।
এর পরে একটি অনুষ্ঠানের জন্য বাইরে চলে যান। সেখানে থাকতেই সব কথা জানতে পারেন তিনি। অনুপমের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেনি মনুয়া? বুবাই বলেন, ‘‘ঝামেলা হয়েছে, এসে কান্নাকাটি করেছে। আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। আমিও ভাবছি, যদি এ সবের বিন্দুমাত্র আভাস পেতাম, তা হলে বোঝাতেও তো পারতাম।’’
সুপারি কিলারে খরচ নয়-তাই খুনি অজিত
খুনের পরে খুনির সঙ্গে একসঙ্গে ১০ দিন! সেই সময়ে মনুয়ার কোনও অস্বাভাবিকতা চোখে পড়েনি? বুবাই বলেন, ‘‘বিশ্বাস করুন, আমি এখনও ভাবতে পারছি না! মারা যাওয়ার পরে ওর কান্নাকাটি, বিলাপ— এ সব ভাবলে আমার এখন কষ্ট হচ্ছে। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’’ এর পরে চোখ-মুখ বদলে যায় বুবাইয়ের। মুখ ঢেকে বলেন, ‘‘এখন আমার একা থাকতে ভয় করছে। আবার কেউ বোঝাতে এলে তাঁকেও বিশ্বাস হচ্ছে না। পরিবারের কেউ হলেও।’’
এই সঙ্কটে ভুগছে মনুয়ার পরিবারও। মনুয়া ধরা পড়ার পর থেকে বাড়িছাড়া মা-বাবা। রানিগঞ্জ থেকে বারাসতের নবপল্লির বাড়ি সামলাচ্ছেন মনুয়ার এক কাকা, মির হালদার। এ দিন তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘জন্ম থেকে মনুয়াকে দেখছি। জন্মদাতা মা-বাবাও যদি কোনও দিন কিছু বুঝতে না পেরে থাকে, আমরা কী করে বুঝব বলুন?’’ পরে তিনি বলেন, ‘‘মনুয়া ওর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও লজ্জা। ‘ভাল মেয়ে’, এই মুখোশের আড়ালে এমন নোংরা কাজ করবে কে ভেবেছিল? ও তো পরিবারটাকেও খুন করে গেল।’’