বিগত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে ভূমিকম্প চলছে। আর রাজনীতির ভূমিকম্প চলেছিল প্রায় তিনমাস ধরে। এই দীর্ঘ তিনমাস বাংলাদেশ ভূমিকম্প নামক রাজনীতির দুর্যোগে জর্জরিত ছিল নানান সমস্যায়। তবে সেই দুর্যোগ থেকে বর্তমানে আমরা রেহাই পেয়েছি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মাধ্যমে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগের মতো কোনো ভয়াবহ ভূমিকম্প আসবে কিনা তা সিটি করপোরেশন নির্বাচনই পূর্বাভাস দেবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আট ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালে ও অন্যান্য কাউন্সিলরের এজেন্টরা ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।আজ মঙ্গলবার সকালে ওই দুই ওয়ার্ডের অন্তত আটটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়ার এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিরপুরের দুই নম্বর সেকশন মিরপুর বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সকালে ভোট শুরু হওয়ার আগেই বিএনপিসহ অন্যান্য মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের এজেন্টরা কেউ নেই। নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন এজেন্ট জানান, কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা বিএনপিপন্থী প্রার্থীদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। কেবল একটি মাত্র বুথে এজেন্ট রয়েছে।
ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা শাহীনা আক্তার নামের এক ভোটার অভিযোগ করেন, তাঁর ব্যালট পেপারে কোনো স্বাক্ষর বা সই কোনোটাই নেওয়া হয়নি। ব্যাপারটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচর করলে বলেন, ভুল হয়েছে। ঠিক এমনই অভিযোগ করেছেন ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা রিয়াজুল হক নামের আরেক ভোটার।ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুই-তিনজন ব্যক্তি নিজেদের এজেন্ট হিসেবে দাবি করছেন। কিন্তু কার এজেন্ট—জানতে চাইলে তা বলতে পারেননি। পরে গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র দেখে বলেন তিনি আনিসুল হকের এজেন্ট।
ওই ভোট কেন্দ্রে কথা হয় ইতি আক্তার নামের আরেক এজেন্ট। তিনি কার এজেন্ট জানতে চাইলে, প্রথমে বলতে পারেননি। পরে নিজের গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র দেখে বলেন, সংরক্ষিত মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী শামীম আরা রাগীবের এজেন্ট।অভিযোগের ব্যাপারে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তাই তিনি কিছু জানেন না।’
মিরপুর এক নম্বর ডি ব্লকের আট নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী কাজী টিপু সুলতানের সমর্থক প্রায় ১০০ জন লোক বেলা ১১টার দিকে মিরপুর উপশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ঢুকে আধা ঘণ্টা ধরে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে পুরেছে। ওই ওয়ার্ডের স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী হাজী কাসেম মোল্লা। এ ঘটনার পর সেখানে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপশহর সরকারি বিদ্যালয়ের দুই ভোটকেন্দ্রের একটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আওলাদ হোসেন ও এমদাদুল হক দাবি করেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে কেউ ব্যালট ছিনিয়ে নিতে পারেননি।সরেজমিনে মিরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কলেজে ও উপশহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি খুব কম।
ওই ওয়ার্ডের মনিকানন উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে বেলা ১১টার দিকে কাউন্সিলর প্রার্থী টিপু সুলতান ও হাজী কাসেম মোল্লার সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এনায়েত কবির বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রের বাইরের পরিস্থিতি খারাপ।’
১৪ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আশরাফ আলী হাই উচ্চ বিদ্যালয়ে রয়েছে আটটি ভোটকেন্দ্র। সেখানের ভোটারদের অভিযোগ, সিরিয়াল খুঁজে পেতে সেখানকার কর্মকর্তারা কোনো সহযোগিতা করছেন না।
রামপুরায় বাইরে গন্ডগোল ভেতরে জালভোট
ঢাকা উত্তরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের রামপুরা একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়ে (বালিকা শাখায়) ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা অভিনব কায়দায় জাল ভোট দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, আজ মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৮-১০ জনের একটি দল ১১ নম্বর ওয়ার্ডের রামপুরা একরামুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়ের (বালিকা শাখায়) গেটে এসে প্রথমে হইচই এবং পরে পুলিশ ও অন্যান্য প্রার্থীর লোকজনের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে।
এরই মধ্যে তাদের ২/৩ জন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং দীর্ঘক্ষণ জালভোট দেয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পোলিং অফিসার জানান, ওই সময় তাঁর বুথেই শতাধিক জাল ভোট দেওয়া হয়েছে। এসব দৃশ্য ধারণ করতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা একটি বেসরকারি টিভির ক্যামেরা ভেঙে ফেলে।
মহাখালীতে প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে ঢুকে দরজা লাগিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল হামিদ দর্জি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এমন ঘটনা ঘটে।
ঘটনার সময় এই প্রতিবেদক প্রিসাইডিং অফিসার মাহফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কক্ষের মধ্যে এমন কিছু ঘটছে না।’
এই ঘটনায় একই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সমর্থন বঞ্চিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
৩ সিটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা বিএনপির
ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। মঙ্গলবার বেলা ১২টা ২০ মিনিটে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ।এর আগে বেলা ১১ টার পর চট্টগ্রামে মনজুর আলম ভোট বয়কট করে সরে দাঁড়ান। আর ঢাকায়ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পুরো পরিস্থিতি তুলে ধরে একসাথে ৩ সিটি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস।সংবাদ সম্মেলনে মওদুদ বলেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশন এই দেশের জনগনের ভোটের অধিকার নষ্ট করেছে। আজকে এটা প্রমানিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনগনের ভোটাধিকারের বদলে সরকারের নির্দেশ পালনেই নিয়োজিত রয়েছে। আবারও প্রমানিত হয়েছে দেশে গণতন্ত্র নেই। মানুষের ভোটের অধিকার নেই। সরকার ও কমিশন জনগনকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
বিএনপি বড় আশা নিয়ে এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলো। কিন্তু সরকার নির্বাচন কমিশন মিলে নির্বাচনকে অর্থহীন করেছে। পুলিশ র্যাব সরকারের ইচ্ছা পূরণ করতে জনগণের সেবা বাদ দিয়ে জনগণের উপর অত্যাচার করেছে, বিএনপি নেতাকর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে। এটি কোনও নির্বাচন নয়, নির্বাচনের নামে প্রহসন। এই নির্বাচন কোন নির্বাচন হয়নি। এই নির্বাচনকে কেউ গ্রহণ করবে না। এই নির্বাচন কেউ কোন দিন মেনে নেবে না।
তিনি বলেন, ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি। ৫৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটিতেই সকাল সারে ৮টা থেকে ৯টর মধ্যেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। বেশিরভাগ কেন্দ্রেই বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। তাই আমরা নির্বাচন বর্জন করছি।
‘আন্দোলনের ইস্যু সৃষ্টির জন্য নাটক করেছেন খালেদা’
সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন বিএনপির পূর্বপরিকল্পিত বলে দাবি করেছে আওয়ামী লীগ।দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘পরাজয় নিশ্চিত জেনে আন্দোলনের ইস্যু সৃষ্টির জন্য নাটক করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।’
বিএনপির তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন ঘোষণার পর মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ সব কথা বলেন তিনি।
শাহনেওয়াজের গাড়িতে জুতা নিক্ষেপ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সুরিটলা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বের হলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজের গাড়ি লক্ষ্য করে জুতা ছুড়ে মেরেছে বিক্ষুব্ধ ভোটাররা। এ সময় তিনি দ্রুত কেন্দ্র ত্যাগ করে চলে যান।মঙ্গলবার সকাল ৯ টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
প্রিজাইডিং অফিসার শওকত আলী জানান, রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশে ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। তবে স্থগিতের কোনো কারণ তিনি জানাতে পারেননি।সকাল ৭ টা থেকে ভোটারা ওই কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে প্রিজাইডিং অফিসারের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধ ভোটারা।
এক পর্যায়ে তারা ভাঙচুর শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে। পরে নির্বাচন কমিশনার শাহওনেওয়াজ সেখানে পরিদর্শনে গেলে তার গাড়িকে লক্ষ্য করে জুতা নিক্ষেপ করে বিক্ষুদ্ধ জনতা।