• রোববার , ২৪ নভেম্বর ২০২৪

মোশাররফের ইন্দ্রজালে চলে ওয়াসা’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল্লাহ


প্রকাশিত: ১০:২৮ পিএম, ৮ আগস্ট ২৩ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৩ বার

এস রহমান : দেশে এত মেধাবী থাকা সত্বেও ৮১ বছরের বয়স্ক এ কে এম ফজলুল্লাহ বার বার বাগিয়ে নিচ্ছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি। অনেকে বলেছেন তিনি নাকি যাদু টোনা জানেন। ফলে তাকে ডিঙ্গিয়ে কেউ ভিড়তে পারে না ওয়াসার শীর্ষ পদটিতে। চট্টগ্রামের মোশাররফের ইন্দ্রজালে ওয়াসা’র ফজলুল্লাহ সকলকে বার বার বশিভূত করে চলেছেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে মুখ খুলেন না ফয়জুল্লাহ! তার কর্মক্ষেত্রে এমন কিছু সাফল্য দেখাতে পারেননি তিনি। বিশ্লেষণ করলে ব্যর্থতার পাল্লাটাই তার। তারপরও ১৪ বছর ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে রয়েছেন ৮১ বছরের বয়স্ক এ কে এম ফজলুল্লাহ। ফলে এই ব্যক্তি একই পদে বার বার পুনর্নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন।তার খুঁটির জোর কোথায়, কেনই-বা বারবার তাঁকেই অবিকল্প ভাবা হচ্ছে, এর কোনো সদুত্তর কি নেই!

তবে ফজলুল্লাহ সাহেব গনমাধ্যমকে বলেছেন, অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণে তিনিই এগিয়ে থাকেন বার বার। ফলে সরকার মনে করছে, আমাকে দায়িত্ব দিলে প্রকল্পের কাজগুলো ঠিকভাবে শেষ হবে। কারণ, প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আমার জানা।ফজলুল্লাহর কথা অনুযায়ী, অভিজ্ঞতাই যদি হবে পুনর্নিয়োগের অন্যতম কারণ, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাঁর আগে চট্টগ্রাম ওয়াসার যেসব কর্মকর্তা নির্দিষ্ট সময়ান্তে অবসরে গিয়েছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কখনো কাজে লাগানোর উদাহরণ আছে কি না। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তাঁর জানা বলে যে দাবি তিনি করছেন, সেটি নিয়েও তো প্রশ্ন উঠবে।

ওয়াসা সরকারের একটি বড় সংস্থা। দক্ষ জনবল দিয়ে সেটি পরিচালিত হয়। কিন্তু এই সংস্থার হাতে থাকা সব প্রকল্প বাস্তবায়নের উপায় কেবল একজনই জানেন কি করে? এখানেই হচ্ছে রহস্য! এখানেই যাদু। এখানেই যারা জড়িত তারাই মোহজালে আটকা পড়ে যান!

তবে চাকরিতে নিজের মেয়াদকাল পূর্ণ করার পর আরও ১৪ বছর কর্মরত থেকেও তিনি যে একজন যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করতে পারলেন না, এই দায়ও তো তাঁর কাঁধে। দেশে সাধারণত রাজনৈতিক পরিচয় ও দলীয় আনুগত্যের হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে সরকারি সংস্থায় পদ-পদবি বাগানোর বা পদে বহাল থাকার রেওয়াজ আছে।

সেটিই এ কে এম ফজলুল্লাহ জানেন। কিন্তু অনেকে বলছেন, সে রকম কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি অত্যুৎসাহী হয়ে সরকারদলীয় সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে স্তুতি-বন্দনা করার ইতিহাসও নেই। তা সত্ত্বেও একবার-দুবার তো নয়, সাত দফায় ১৪ বছর একই পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। এবার আরও ৩ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে তাঁর কর্মজীবনের মেয়াদ। তাহলে প্রশ্ন উঠেছে কে তার গডফাদার!যিনি যাদুতে বশ করে রাখেন সকলকে! ফজলুল্লাহর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কিন্তু পরিসংখ্যানে মিলে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, দুই বছরের মধ্যে (অর্থাৎ ২০২০ সালে) চট্টগ্রামবাসী ২৪ ঘণ্টা নিরাপদ পানি পাবেন। সেই সময়সীমা পেরিয়েছে তিন বছর আগে। ২৪ ঘণ্টা তো দূরে থাক, দিনে দু-চার ঘণ্টা পানিও পাওয়া যায় না, এমন এলাকা চট্টগ্রামে বরং বেড়েছে। আর ‘নিরাপদ’ ব্যাপারটা প্রশ্নবিদ্ধ!!
ফলে লবণাক্ত পানি পান ও ব্যবহার করা এ অঞ্চলের মানুষ প্রায় নিয়তি নির্ধারিত হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, আটবার একজনের মেয়াদ বাড়ানো হলে, বিশেষত তিনি যদি ৮১ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি হন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে অস্বাভাবিক মনে হতে বাধ্য। পাঁচ বছর আগের দেওয়া ঘোষণা বাস্তবায়িত হলো না কেন, এ প্রশ্নের উত্তরে একটি সংবাদমাধ্যমে খুবই সাদামাটা একটি উত্তর দিয়েছেন ফজলুল্লাহ সাহেব। তিনি বলছেন, আমাদের শিল্প ও আবাসিক খাতে চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ফলে পাঁচ বছর আগে তিনি যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার মিল নেই। সময়ের সঙ্গে চাহিদার চাপ বাড়ছে, এ ধরনের কথা বলার জন্য তো বিশেষজ্ঞ বা ওয়াসার এমডি হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই চাহিদার কথা মনে রেখেই তো প্রকল্প তৈরি হয়।

দুই বছরের মধ্যে নিয়মিত ২৪ ঘণ্টা পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তিনি ১৪ বছরে ১৪ দফা পানির দাম বাড়াতে কিন্তু দ্বিধা করেননি। এর মধ্যে গত বছর এক ধাক্কায় ৩৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে নগরবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত করেছেন। তাহলে কী বিবেচনায় পুরস্কৃত (চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি) হলেন তিনি? ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের মূল বেতন ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। সে হিসেবে তিনি বোনাস পাচ্ছেন ১০ লাখ ১ হাজার টাকা।

ফজলুল্লাহ যেমন জানেন, আমরাও জানি, মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে পানির উৎপাদন বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নিতে হবে। পয়োনিষ্কাশনের প্রকল্প বাস্তবায়নও ওয়াসারই কাজ। এসব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একইভাবে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কর্মকাল অতিবাহিত হলে অন্য একজন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন, এটাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আটবার একজনের মেয়াদ বাড়ানো হলে, বিশেষত তিনি যদি ৮১ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি হন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে অস্বাভাবিক মনে হতে বাধ্য।

২০০০ সালে অবসরে যাওয়া মানুষটিকে আট বছর পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেন চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হলো, এ রহস্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, লাহোরে পড়াশোনা করার সময় একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের দুই বছরের জুনিয়র ছিলেন তিনি। ধারণা করা হয় তখন থেকে দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীকালে দল ক্ষমতায় এলে হয়তো মোশাররফ হোসেনের এই করিতকর্মা ব্যক্তিটির কথা মনে পড়ে বা তিনি নিজে এসেও পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে মন্ত্রীর কাছে দেনদরবার করেন। এতে তাঁর অবসর থেকে ফিরে আসার পথ সুগম হয়। এসবই অনুমানের কথা।

এ সম্পর্কে টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি জানান, এ কে এম ফজলুল্লাহকে যাঁরা নিয়োগ দেন, তাঁদের সন্তুষ্ট রাখার কাজে তিনি পারদর্শী। বোর্ডের সদস্যদেরও তিনি সন্তুষ্ট রাখতে পারেন। এ কারণে পানির সংকট দূর করতে না পারলেও পুনর্নিয়োগে কোনো অসুবিধা হয় না, এটাই বাস্তবতা এবং এটাই ফয়জুল্লাহর যাদু!!