মুখোমুখি রাজনীতি-ফের লাঠি টিয়ারসেল
বিশেষ প্রতিনিধি : ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শনির আখড়া, পুরনো ঢাকার নয়াবাজার, ধোলাইখাল ও সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের সাথে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে।পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ধাওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে উত্তরায় জড়ো হওয়া বিএনপি নেতাকর্মীরাও। বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষের সময় পুলিশের একটি গাড়িসহ আরও কয়েকটি বাসে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
সংঘর্ষের সময় আহত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে আটক করে পুলিশ। তার আগে তাকে লাঠিপেটা করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এরপর তাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার পুলিশ দাবি করেছে, তাকে ‘সেফ’ করার জন্য তাকে ডিবিতে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের গাড়িতে তাকে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়ায় সকাল থেকে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ, এপিবিএন ও আনসারের বিপুলসংখ্যক সদস্য। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নেয় শনির আখড়ার দনিয়া কলেজের সামনে। আগে থেকে সেখানে অবস্থান নিয়ে ছিল যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। অন্যদিকে শনির আখড়ার অদূরে মাতুয়াইল শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনে বিএনপির কয়েক শ নেতা-কর্মী অপেক্ষা করছিল। তাঁদের হাতে লাঠি, মুখে সরকারবিরোধী স্লোগান। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দাঁড়িয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা।দুপক্ষের সংঘর্ষের কারণে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বহু যানবাহন আটকা পড়ে। শনিবার ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাতুয়াইল এলাকায় দুপক্ষের সংঘর্ষের কারণে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বহু যানবাহন আটকা পড়ে।
বেলা সাড়ে ১১টার পর শনির আখড়া থেকে সাঁজোয়া যান, জলকামান নিয়ে পুলিশ সদস্যরা এগোতে থাকেন মাতুয়াইল শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দিকে। পুলিশের পেছনে পেছনে লাঠি হাতে ছিলেন যুবলীগের নেতা-কর্মীরাও। একপর্যায়ে দূর থেকে পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকেন। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ছুড়তে থাকেন ইটপাটকেল। আতঙ্কে লোকজন ছুটতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শনিবার এমন ‘ভীতিকর’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিপরীত পাশে বাসসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আটকে যায়। বাস লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে দেখা যায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের।
পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট আর বিএনপির নেতা-কর্মীদের মারমুখী অবস্থানের কারণে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেককে বাস থেকে নেমে দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে দেখা যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে পুলিশ এবং বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া।
বেলা একটার দিকে যখন শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনে তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন আতঙ্ক আরও ছড়িয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর ইনস্টিটিউটের বিপরীত পাশে স্বদেশি পরিবহনের একটি বাসেও আগুন দেওয়া হয়। তখন মাতুয়াইলের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশের দোকানপাট বন্ধ করে দিয়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে যান ব্যবসায়ীরা।
মাতুয়াইলের বাসিন্দা মির আলম বলেন, সড়কে শত শত পুলিশ অবস্থান নিয়েছে; বিএনপির নেতা-কর্মীদের হাতে লাঠি। যুবলীগের নেতা-কর্মীদের হাতেও লাঠি। বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কিছু সময়ের জন্য যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। দুপুর সাড়ে ১২টার পর সংঘর্ষ কিছুটা কমে এলে যাত্রাবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা যানবাহন দ্রুত কাঁচপুরের দিকে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর আবার বিএনপির নেতা-কর্মীরা শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেয়। পুলিশ তখন পিছু হটে রায়েরবাগের দিকে চলে যায়। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশকে ধাওয়া দেন, ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন আবার দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনে টায়ারে আগুন ধরিয়ে সড়কে অবস্থান নেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। পরে শনির আখড়া থেকে আরও পুলিশ এসে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিলে তাঁরা আবার শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গলিতে অবস্থান নেন। তখন পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এ সময় বিএনপির নেতা-কর্মীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুড়তে থাকেন।
মাতুয়াইলে সংঘর্ষের খবরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ঢাকাগামী সব যানবাহনের যাত্রীদের কাঁচপুর, সাইনবোর্ডে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে যাত্রীরা কাঁচপুর থেকে হেঁটে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। মাতুয়াইলে শিশু–মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সামনের সড়কে পড়ে থাকা ইটের টুকরা, জ্বলন্ত টায়ার ও জ্বলন্ত বাস দেখে এসব মানুষের চোখেমুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে দূরে সরে গেছেন, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠি হাতে সড়কে। সড়কে সতর্ক অবস্থানে পুলিশ ও র্যাব। পরিস্থিতি তখন অনেকটাই শান্ত। ঠিক তখন মাতুয়াইলের শান্ত ফিলিং স্টেশনের সামনে তিন যুবক একটি বাসে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। বেলা ১টা ৪০ মিনিটের দিকের এই ঘটনায় মাতুয়াইলের বাসিন্দাদের মধ্যে আবার আতঙ্ক ছড়ায়।স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের চোখের সামনে তিনজন যুবক সবার সামনে বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমরা খুব ভয়ে আছি, কখন যে কী হয়!
গাবতলীতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় পুলিশের হাতে আটক হন বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান। তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়।পরে চিকিৎসাধীন আমানউল্লাহ আমানকে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান। সেই প্রতিনিধি দল মি. আমানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো দুপুরের খাবার, নানা ধরনের ফল এবং ফলের রসসহ একটি উপহারের ঝুড়ি তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রতিনিধি দলটি তাঁকে দেখতে গিয়েছে। বেলা ১১টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল বিএনপি।
সকাল থেকেই প্রায় সব পয়েন্টেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মহড়ার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যায় পুলিশের উপস্থিতি দেখো গছে। এরমধ্যেই নয়াবাজার, ধোলাইখাল, উত্তরা ও গাবতলীসহ কয়েকটি জায়গায় জড়ো হতে শুরু করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
বেলা সাড়ে এগারটার দিকে সংঘর্ষ শুরু হয় নয়াবাজার ও ধোলাইখাল এলাকায়। সেখানে এ সময় মুহুর্মুহু টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা ছাড়াও ফাঁকা গুলির শব্দ শোনা গেছে। বেলা পৌনে বারোটার দিকে সংঘর্ষ ধোলাইখালের মূল সড়ক ছাড়াও অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে।সংঘর্ষ শুরুর পর বিএনপি কর্মীরা যখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটের টুকরো নিক্ষেপ করছিলো তখন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে একদল নেতাকর্মী সড়কের এক পাশে অবস্থান করছিলো। উল্টো দিক থেকে তাদের লক্ষ্য করে ইটের টুকরো নিক্ষেপ করছিলো পুলিশও। ওই অবস্থায় মি. রায় সেখানেই দাঁড়িয়ে যান।
এক পর্যায়ে ইটের টুকরো মাথায় পড়লে তার মাথা থেকে রক্ত পড়তে দেখা যায়। এরপর পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরে। এ সময় কয়েকজন পুলিশ তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন।একপর্যায়ে তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়লে তখনও একজন পুলিশ তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করছিলেন। পরে পুলিশ সদস্যরা তাকে তাদের গাড়ীতে তুলে নিয়ে যায়।
সংঘর্ষে বড় আকারে ছড়িয়ে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায়। টিয়ারশেলের পাশাপাশি জলকামান, সাজোয়া যান নিয়ে পুলিশ বিএনপি কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে। এসময় গুলির শব্দও শোনা গেছে সেখানে। সংঘর্ষের কারণে বন্ধ হয়ে যায় ওই সড়কের যান চলাচল।
শুক্রবার বিএনপি ঢাকার প্রবেশমুখে কর্মসূচি ঘোষণার পর একই জায়গায় পাল্টা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ। রাজনৈতিক এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যেই পুলিশ জানিয়েছিল যে কেউ শনিবার কোনো কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেবে। পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল।শুক্রবার রাতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল যে আইনশৃঙ্খলা অবনতির গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় শনিবার সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থান কর্মসূচি পালনে ডিএমপির পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়া হলো না।