‘মন্ত্রী সিন্ডিকেট’বিব্রত সরকার-শিল্প প্রতিমন্ত্রী স্বাভাবিক
শফিক রহমান : শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের ‘মন্ত্রী সিন্ডিকেট’ তত্বে তোলপাড় চলছে। তার এ কথায় সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী থেকে অনেক প্রবীন সংসদ সদস্য ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। তবে অনেকে বলেছেন, কামাল মজুমদার উচিত কথা বলেছেন। এতে অনেকের থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। প্রতিমন্ত্রীর কথায় ফাঁস হয়েছে অনেক মন্ত্রীর আখের গোছানোর সিন্ডিকেট রহস্য। এই রহস্যে আরো একটু বেরিয়ে পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন মন্ত্রী সিন্ডিকেট। তাই সিন্ডিকেট মন্ত্রীরা তোপ দাগাচ্ছেন প্রতিমন্ত্রীর প্রতি। তারা বোঝাতে চাচ্ছেন সরকার কে বেসামাল করতে কিংবা চরম বিব্রত করতে এটা করা হয়েছে।
এদিকে হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দেয়ার মত অবস্থায় এবার চুপ মেরে গেছেন কামাল আহমেদ মজুমদার। কারো ফোনও ধরছেন না। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। কামাল আহমেদ মজুমদারের ব্যক্তিগত সহকারী বলছেন, স্যার খুব আপসেট। এখন কথা বলতে পারবেন না।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কামাল মজুমদার ওই দিন যা বলেছেন, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলেছেন। গত ১১ মে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে ‘কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসএমই খাতের উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দিচ্ছিলেন। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। ওই সময় তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছিলেন, দেশের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। পকেটে টাকা নেই, মানুষ বাজারে গিয়ে কাঁদে। সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে নিয়ে গেছে।
এর অন্যতম স্বাক্ষী এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মাসুদুর রহমান।
প্রতিমন্ত্রী ওই দিন বলেন, দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে কিছু লোক হঠাৎ ব্যাংকের মালিক বনে গেছে। এ নিয়ে কামাল মজুমদার আরো বলেন, এক সময় যারা (বর্তমান সরকারের সুবিধাভোগী) ব্রিফকেস নিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতো, পকেটে খাওয়ার টাকা থাকতো না, মানুষের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে খেতো, আজকে তারা ব্যাংকের মালিক। সরকারি ব্যাংকের টাকা নিয়ে তারা কীভাবে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন?
যারা এ রকম সরকারি ব্যাংকের টাকা নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন, তাদের নামগুলো প্রকাশ করা প্রয়োজন। অথচ দেশের বেশির ভাগ খেটে খাওয়া মানুষের পকেটে টাকা নেই। বাজারে প্রতিটি পণ্যের মূল্য আকাশ ছোঁয়া। মানুষ বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্য কিনতে না পেরে কাঁদেন।
কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, বাজারে আজ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি। অথচ দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দানাদার খাদ্য থেকে শাক-সবজি, মাছ, গোশত সবকিছু বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেট করে সবকিছুর দাম বাড়িয়েছে। তিনি বলেন, যারা মুড়ি চানাচুর তৈরি করে জীবন নির্বাহ করে তারা আজ বড় বড় কোম্পানির কাছে টিকতে পারছে না। এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখন মুড়ি-চানাচুরের মতো ব্যবসা করতে শুরু করেছে।
এদিকে এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রতিমন্ত্রী একটি পত্রিকাকে বিশেষ সাক্ষাতকারও দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রীদের ভেতরেই সিন্ডিকেট আছে’—! এবার
এমন বক্তব্য দিয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। ওদিকে প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিব্রত মন্ত্রিসভার সদস্যরা। বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ নেতারাও। তাঁরা বলছেন, মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় বেফাঁস বক্তব্য দেন আর তার জবাব দিতে হয় তাঁদের।
বাজেট নিয়ে কর্মশালায় কামাল আহমেদ মজুমদার ওই বক্তেব্যর জের ধরে অনেক মন্ত্রী এখন ক্ষুদ্ধ। আবার অনেক মন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে মজা করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর সরকারের সমালোচনা প্রকাশ্য চলে আসলে
নানা আলোচনার জন্ম দেয়। মুখ খুলেন খোদ ওবায়দুল কাদের। ১৩ মে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে কামাল আহমেদ মজুমদারের উদ্দেশে বলেন, নিজে মন্ত্রী, সিন্ডিকেট নিজে থামান। এগুলো বললে নিজের গায়ে আসে।
তবে ওবায়দুল কাদেরের ওই বক্তব্যের পর একটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে কামাল আহমেদ মজুমদার মন্ত্রিসভার সদস্য, আমলাদের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, মন্ত্রীদের ভেতরেই সিন্ডিকেট আছে। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা মন্ত্রী। নিজ মন্ত্রণালয়েও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নেই বলে উল্লেখ করেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী।
প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যসহ একাধিক সিনিয়র নেতা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
তবে বেশির ভাগ সংসদ সদস্য এনিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে চাননি। সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা তো বিষয়টি নিয়ে মানুষের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, কামাল আহমেদ মজুমদার এটা বলেছেন নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
খবর নেন, বিসিআইসিতে সারের হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। নিজের মন্ত্রণালয়ের ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য উনি আগে থেকে সমালোচনা শুরু করেছেন বলে মনে হচ্ছে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য্য বলেন, এটা যে বলেছেন তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করা ভালো। একজন একটা কথা বলেন, আর সেই প্রশ্নের জবাব দিতে হয় আমাদের।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, তিনি (কামাল মজুমদার) সরকারের অংশ। দলে আছেন। উনি তো এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। ওনার সিনিয়র কেউ যদি উল্টাপাল্টা করেন, সেটা নিয়ে তিনি এভাবে না বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলতে পারতেন। তিনি বলেন, এটা নিয়ে তো মানুষের মধ্যে খারাপ ধারণা হবে। এটাই স্বাভাবিক। ওনার এই ধরনের বক্তব্য দেওয়া উচিত হয়নি। দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে নিশ্চয়ই আলোচনা হবে। তখন তাঁর কাছে হয়তো বক্তব্য দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, কামাল আহমেদ মজুমদার ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মিরপুর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে ২০০১ সালে হেরে যান। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ওই আসনকে ভেঙে তিনটি করা হয়। ওই নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও ছিলেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তাঁর এভাবে বলা উচিত হয়নি। আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
এদিকে বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী উপস্থিত থাকায় শিল্প প্রতিমন্ত্রী ছিলেন না। বৈঠকে উপস্থিত কয়েক মন্ত্রী দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানান, কামাল আহমেদ মজুমদারের বক্তব্য নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়নি। সহকর্মীর বক্তব্য নিয়ে তাঁরা সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত। এটা ওনাদের (শিল্পমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী) বিষয়। তা নিয়ে আমাদের কথা না বলাই ভালো। আরেক মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটা নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। বৈঠকে তিনি (শিল্প প্রতিমন্ত্রী) ছিলেন না। ওনার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। ওই বিষয়টি আমি শুনিনি, জানি না। তাই কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, সিন্ডিকেটে কে কে আছেন, সেটা উনিই (শিল্প প্রতিমন্ত্রী) ভালো জানেন। আমার জানার কথা নয়। তাঁকেই জিজ্ঞাসা করেন।