• শনিবার , ২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ চলচ্চিত্র- গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরবে’


প্রকাশিত: ১:২২ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৫৬ বার

‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ চলচ্চিত্র’র মহরতে তথ্যমন্ত্রী সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরিন আখতারসহ ছবির কলাকুশলীবৃন্দ

বিশেষ প্রতিনিধি : ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণদানকারী উপমহাদেশের প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মরণে নির্মিতব্য ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ চলচ্চিত্রটি নতুন প্রজন্মের কাছে গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কাকরাইলে তথ্য ভবন মিলনায়তনে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৯-২০ অর্থবছরের অনুদানে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মীয়মাণ এ চলচ্চিত্রের মহরত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মন্ত্রী এসব কথা বলেন।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরিন আখতার। আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে কথা বলেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক স. ম. গোলাম কিবরিয়া ও সংস্কৃতিক সংগঠক আমিন হেলালী। ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক প্রদীপ ঘোষ, সংগীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদার ও অভিনেতা মান্নান হীরা নির্মিতব্য সিনেমাটির ওপর আলোকপাত করেন।

জানা যায়, চলচ্চিত্রটিতে প্রীতিলতার চরিত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা, বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস চরিত্রে মনোজ প্রামানিকের পাশাপাশি আরো অভিনয় করছেন মান্নান হীরা, মূন্ময়ী রূপকথা, কামরুজ্জামান তাপু, ইন্দ্রানী ঘটক, অমিত রঞ্জন দে, সুচয় আমিন, পাশা মােস্তফা কামাল, মিজান রহমান, আহমেদ আলী, নাজমুল বাবু, সুধাংশু তালুকদার, আরিফুল ইসলাম হাবিব, পংকজ মজুমদার, তামিমা তিথী প্রমুখ৷এছাড়াও চলচ্চিত্রটির রূপসজ্জায় থাকছেন শিল্পী মোহাম্মদ আলী বাবুল। চলচ্চিত্রের পোশাক পরিকল্পনায় রয়েছেন শিল্পী কনক আদিত্য। সংগীত পরিচালনা করছেন শিল্পী বাপ্পা মজুমদার। প্রীতিলতা চলচ্চিত্রে লোগো এঁকেছেন শিল্পী মামুন হোসাইন। শিল্প নির্দেশনায় রয়েছেন শিল্পী জাহিদ মোস্তফা এবং মুজিবুল হক। প্রযােজনা নির্বাহী হিসেবে থাকছেন রিফাত মোস্তফা।

তথ্যমন্ত্রী বলেন, সেই সময় যখন নারীরা ঘর থেকে বের হতো না, তখন মেধাবী প্রীতিলতা যেভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, সেটি সমগ্র উপমহাদেশে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আজ প্রীতিলতাকে নিয়ে সিনেমা নির্মিত হচ্ছে এবং আশা করা যায় যে এটি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভারত ও অন্যান্য দেশেও প্রদর্শিত হবে। সুন্দরভাবে নির্মিত হলে এটি ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে এবং নতুন প্রজন্ম, যারা ত্রিশের দশকে বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস জানেন না, তাদের সঠিক ইতিহাস জানানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

মানুষ গড়ার জন্য চলচ্চিত্র শিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে উল্লেখ করে ড. হাছান বলেন, চলচ্চিত্র শুধু বিনোদন নয়, শুধু ইতিহাস নয়, এটি মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। প্রত্যেকটি চলচ্চিত্রে একটি বার্তা থাকতে হবে। আজ অনেক মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, অথচ প্রায় শতবর্ষ আগে প্রীতিলতা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য। ব্রিটিশদের হাতে নিহত পুরুষবেশী প্রীতিলতার পকেটে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ৩২ পৃষ্ঠার জবানবন্দি পাওয়া গিয়েছিল। সেই জবানবন্দি বই-পুস্তকে আছে। প্রীতিলতা তেমনই একজন বিপ্লবী ছিলেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এই দেশে সিনেমা শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একজন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর আমাদের দেশে ছবি নির্মাণ শুরু হয় এবং বহু কালজয়ী ছবি নির্মিত হয়েছে। যে ছবিগুলো স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে দেশ গঠনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে এবং বহু কালজয়ী শিল্পীর জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আজকে চলচ্চিত্রে সেই পরিস্থিতি নেই। আমাদের লক্ষ্য চলচ্চিত্রের পুরনো সেই দিন ফিরিয়ে আনা। এ কারণে চলতি বছর থেকে আমরা চলচ্চিত্রের অনুদান ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকায় উন্নীত করেছি। এ বছর সর্বোচ্চ ১৬টি চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বন্ধ সিনেমা হল চালু, নতুন হল নির্মাণ এবং আধুনিকায়নের জন্য সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ তহবিল গঠনের অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং আবারও অনেক সিনেমা হল চালু হবে।কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, বিশেষ অতিথি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরিন আখতার এবং আমন্ত্রিত বক্তারা ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ চলচ্চিত্রের সুন্দর নির্মাণ ও সাফল্য কামনা করেন।

এই সেই পাহাড়তলীর তৎকালীন ইউরোপীয়ান ক্লাব, ইনসেটে বিপ্লবী প্রীতিলতার ভাস্কর্য

গৌরবময় ইতিহাস- ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ চলচ্চিত্র’ গৌরবময় ইতিহাসতুলে ধরতে গিয়ে আমন্ত্রিত বক্তা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক স. ম. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারনে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে প্রহরীদের অবস্থান ছিল। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা ব্যাতীত এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ঐ ক্লাবের ধারে কাছে যেতে পারতো না। ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো। আত্মগোপনকারী বিপ্লবীরা ১৯৩২ এর ১০ আগষ্ট থেকে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের জন্য নুতনভাবে পরিকল্পনা শুরু করে।

শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটা দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হবার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার যদি সুযোগ থাকে তবুও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। মাষ্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের উপর দেবেন বলেন মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পরে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার উপর।

২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোষাক পড়ানো হয়েছিল। আক্রমণে অংশ নেয়া কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী পোষাক ছিল ধুতি আর শার্ট। লুঙ্গি আর শার্ট পরনে ছিল মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে আর পান্না সেন এর।

বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার (বিপ্লবীদের দেয়া তাঁর গোপন নাম ছিল জয়দ্রথ) ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে আর মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং ৯ ঘড়া পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন।

প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারনে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করল। সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাত জন নারী আহত হয়।আত্মাহুতির স্থানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ২০১২ সালের ২ অক্টোবর প্রীতিলতার ব্রোঞ্জমূর্তি উন্মোচিত হয়।​

পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্বান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তাঁর রিভলবারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে।