দুদিন পর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে টস করতে নামবেন। সেই রোমাঞ্চ ছাপিয়ে কাল সারা দিন মাশরাফি বিন মুর্তজার মনে বেদনার ছায়া। অকালপ্রয়াত প্রিয় বন্ধু মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুবার্ষিকীতে ব্যথাতুর মাশরাফি।
সকালে উঠেই মনে হয়েছে এই দিনে রানা চলে গিয়েছিল। আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল ও। টুরে একসঙ্গে ঘুমাতাম। ও আলো থাকলে ঘুমাতে পারত না। দরজার নিচে যে একটু ফাঁক থাকে, ওখান দিয়ে আলো আসত বলে টাওয়েল গুঁজে দিত। আমি আবার অন্ধকারে ঘুমাতে পারি না। ওকে তাই মারতাম। ও-ই তাই স্যাক্রিফাইস করত। বলত, তুই আগে ঘুমা, আমি পরে ঘুমাব, আমি অন্ধকার ছাড়া ঘুমাতে পারি না
২০০৭ বিশ্বকাপে রানা মারা যাওয়ার পরদিনই ভারতের সঙ্গে ম্যাচ ছিল। এবার আরেকটি বিশ্বকাপে দুই দিন পর সেই ভারতের সঙ্গেই খেলা। আসলে এই দুনিয়াতে কাকতালীয়ভাবে অনেক কিছুই মিলে যায়। আমরা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জিতলে তো দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে খেলতে হতো। আমরা এখন ভারতের সঙ্গে খেলছি।এই মেলবোর্ন অনেক কিছু নিয়ে নিয়েছে… রক্ত, মাংস…এবার যেন কিছু ফিরিয়ে দেয়। এই কোয়ার্টার ফাইনাল আবার সেই মেলবোর্নেই নিয়ে এল!
এই মেলবোর্নে আমি অনেক কষ্ট করেছি। অপারেশনের পর অপারেশন। অপারেশন তো অজ্ঞান করে করেছে। বুঝিনি। কিন্তু এরপর যে কষ্ট…হাঁটতে পারি না, সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত বের করা…২০০৩-এ প্রথম আসি মেলবোর্নে।
এরপর তো আরও অনেকবার। তবে এবারই প্রথম মেলবোর্নে খেলব।
তবে এখানে যে উইকেট দেখছি, তাতে এটা ভেজা থাকার কোনো চান্স নেই। এখানে মনে হয়, ৩০০ রানের উইকেটই থাকবে। তবে ওই বার আমি ভালো বোলিং করলেও আমরা সবাই মিলে ভালো খেলেছিলাম বলেই জিততে পেরেছিলাম। পুরো টিম পারফরম্যান্স ছিল। এখানেও আমাদের টিম একসঙ্গে ভালো খেললে সুযোগ থাকবে। ওদের যে দল, তাতে আমরা এক-দুজন ভালো খেললে পারব না।
তবে এই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকান বোলাররাও সংগ্রাম করছে, ভারতীয় বোলাররা এখনো সত্যিকার চ্যালেঞ্জে পড়েনি। অস্ট্রেলিয়ারও মিচেল স্টার্ক ছাড়া আর কেউ এমন বিরাট কিছু করেনি। বিশ্বের সেরা বোলিং অ্যাটাক বললে আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কথা বলবেন। নিউজিল্যান্ড নিজেদের মাঠে খেলেছে বলে ভালো করেছে, তার পরও আমাদের কাছেই ওদের বোলাররা মার খেয়েছে। এখানে ইউএই পর্যন্ত ২৫০ রান করে ফেলছে। এর কারণ হচ্ছে, এখানে ট্রু উইকেট, বল উঁচু-নিচু হয় না। ব্যাটসম্যানদের বিশ্বাস থাকে যে, বল ব্যাটেই লাগবে। এখানে তাই বোলিংটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে অনেকে মনে করছে ভারতের বিপক্ষে পড়েছি বলে আমরা লাকি। আবার আনলাকিও মনে করছে অনেকে। আমি বলব, সমান সমান। এই বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার পরই ভারত সবচেয়ে ভালো খেলছে। ভারতের এই ব্যাটিংয়ের বিপক্ষে বোলিং করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটা নিয়ে যদি আমরা জিততে পারি, ম্যাচটা খুব এক্সাইটিং হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, সবাই ভাবত আমরা অনেক বড় টিম। নকআউট ম্যাচে চাপ আছেই। সব দলই চিন্তা করবে, হেরে গেলেই বিদায়। আমরা যদি নিজেদের আট নম্বর দল ধরি, একমাত্র আমাদেরই এ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ, আমাদের হারানোর কিছুই নেই। বাংলাদেশের মানুষ তো আশা করেছেই, কিন্তু এই বিশ্বকাপ নিয়ে এত যে কথা শুনেছেন, কাউকে কি বলতে শুনেছেন বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারবে? কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর বলা হচ্ছে, ওরা কি এই চাপ নিতে পারবে? আমাদের ওপর কিসের চাপ, চাপ তো থাকবে অন্য দলের ওপর।
আমরা তো বাংলাদেশের মানুষকে তেমন কিছুই দিতে পারিনি। যদি চিন্তা করে দেখেন, আমরা গত ১৫ বছর একঘেয়ে ক্রিকেট খেলে গেছি। কখনো হয়তো জিতেছি। আমি সব সময়ই বলি, বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রতিটি জয়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমরা খুব বাজে খেলে হেরেছি। তার পরও বাংলাদেশের মানুষ আমাদের দিনের পর দিন সমর্থন করে গেছে। খারাপ খেললে গালি দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিনের পর দিন আমাদের যেভাবে সমর্থন দিয়েছে, এটা অসাধারণ।
ভারতের যে-ই দাঁড়িয়ে যাবে, সে-ই ম্যাচ বের করে নিয়ে যেতে পারবে। ধাওয়ান আছে, রোহিত শর্মা ওয়ানডেতে ২৫০-এর বেশি রান করেছে। রায়না গত ম্যাচে এক শ মারল। ধোনি তো অহরহ করে আসছে। এমনকি রাহানেও দুর্দান্ত ক্রিকেটার। তার পরও কোহলির কথা আলাদা করে বলব, কারণ ও এমন একজন ব্যাটসম্যান, যে ম্যাচ শেষ করে দিয়ে বেরোবে। ধোনিও তা করে, তবে ও যেখানে খেলে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কোহলি তিন-চারে নেমেও শেষ পর্যন্ত খেলে আসে। এটাও একটা-দুইটা বা পাঁচটা-ছয়টা ম্যাচ না, অসংখ্য ম্যাচে এমন করেছে। ওর উইকেটটা তাই তাড়াতাড়ি নিতে হবে। এত দূর যখন এসেছি, সহজে ছাড়ব না। আমরা সবাই নিজেদের উজাড় করে দেব।