• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ


প্রকাশিত: ১১:৩২ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২৪ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২১ বার

শফিক রহমান : ‘সরকার কি তাহলে প্রতিবিপ্লবের মুখোমুখি?’এমনটা লিখেছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেছিলেন সরকার ‘প্রতিবিপ্লবের’ কোনো ঝুঁকিতে আছে কি না? উত্তরে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘এটা নতুন কোনো খবর নয়। আমরা সবাই জানি এবং দেখছি। নানাভাবে সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা হচ্ছে। চোখ-কান খোলা রেখেছি, যা ব্যবস্থা নেওয়ার, নিচ্ছি।’

মতিউর রহমানের ওই সাক্ষাতকারের পর রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে নানা আলোচনা আন্দোলন সূত্রপাত হয় এবং একটি দল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে রাষ্ট্রপতিকে সরাতে অস্বীকার করে বসে। এতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি পদ নিয়ে নতুন করে কোনো উত্তেজনা দেখা দেয়নি। কিন্তু রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনার ফের অন্যরকম আলোচনা শুরু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যার দিকে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতার ব্যানারে একদল লোক একটি মিছিল নিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে যায়। সেখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আগুন দেওয়া হয়। দুই পক্ষই দাবি করেছে, তাদের ওপর আগে হামলা হয়েছে।

এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হঠাৎ করে ২২ অক্টোবর পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে সরকারের প্রতি সময়সীমা বেঁধে দেয়। অথচ অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও তারা সরকারের অংশ। তাদের একটি দাবি অর্থাৎ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করার বিষয়টি কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ার মতো চলছে।

সবমিলিয়ে রাজনীতি এখন বেশ সরগরম। ছাত্রদের দাবিই বেশী প্রাধান্য পাচ্ছে। ছাত্ররা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি দিয়ে বলেছে ‘অভ্যুত্থান ও জুলাই বিপ্লবের চেতনার আলোকে প্রক্লেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা করা। এই দাবি অস্পষ্ট। এখানে আরও একটি বিষয় হচ্ছে ‘জুলাই বিপ্লব’ শব্দবন্ধের ব্যবহার। একই সময় আদালতে দুটি রিট করে পরে তা প্রত্যাহার করে নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন নেতা। এতেও নানা অস্থিরতার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে বলে রাজনীতিকরা বলাবলি করছেন।
প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কি বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব অবশ্যম্ভাবী? প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের জবাব ছিল ‘ইতিহাস তো তাই বলে। আমরা আমাদের কাজ করছি। কিছু ভুলত্রুটি তো আছেই।

যাহোক, বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব নিয়ে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী সি রিট মিল বলেছেন, প্রতিবিপ্লব প্রমাণ করে যে বিপ্লব দরকারি হয়ে পড়েছিল এবং সমাজে যে আসলেই বিপ্লব ঘটেছে, তা–ও নিশ্চিত করে। এখন ৫ আগস্টের পর প্রতিবিপ্লবের যে ঝুঁকির কথা শোনা যাচ্ছে তা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে সরকারসহ সকলকে।

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট যে বিপ্লব ঘটেছে তাতে হাসিনা পালিয়ে গেলেও ফেসিস্ট সহযোগীরা বহাল রয়েছে এখনও। এই ফেসিস্টরাই ছড়ি ঘোরাচ্ছে। এটা সরাসরি জানিয়েছেন তারেক রহমান । বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ২৯ অক্টোবর বলেছেন, মাফিয়া চক্রের বেনিফিশিয়ারি কাউকে রাষ্ট্র ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ নয়।

অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পরাজিত অপশক্তি এবং শাসন প্রশাসনে থাকা তাদের দোসররা নানা কৌশলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে।তিনি আরো বলেন যে, যারা সরকারে রয়েছেন এবং গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি আমরা যারা এই সরকারের সমর্থনে রয়েছি আমাদের প্রত্যেকটি কাজ অগ্রাধিকারভিত্তিক এবং সুবিবেচনাপ্রসূত হওয়া জরুরী যাতে পরাজিত অপশক্তি কোনো সুযোগ নিতে না পারে।

অনেকে শেখ হাসিনার সরকারের পতনকে ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলেছেন। তবে বিপ্লবের পর সরকার ও রাষ্ট্রে যে ধরনের বদল দেখা হয়, এখানে তা ঘটেনি। তবে এই গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি ফ্যাসিবাদী সরকারকেই ক্ষমতা থেকে সরায়নি, জনগণের অনেক চাওয়া পাওয়ার প্রত্যাশাকে সামনে নিয়ে এসেছে।‘রাষ্ট্র সংস্কার’ এখন একটি সর্বজন স্বীকৃত দাবি।
ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানে অনেক বিপ্লবী চাওয়া-পাওয়া রয়েছে। ৫ আগস্ট দেশে বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান যা–ই ঘটুক, সেই পরিবর্তনকে উল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্র
প্রতিবিপ্লবী চক্র চালিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করছে।

এই প্রতি বিপ্লবীরা পরবর্তী নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার চেষ্ঠা করছে। এরা ফেসিস্টদের সহযোগীতায় রাজনৈতিকসহ নানা ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে নিজেরা ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি করতে পারে। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ এখন এই দুই দিক থেকেই ঝুঁকির মুখে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি কয়েক দিন ধরে দেশের রাজনীতি যে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে এই ধারণা জোরদার করার মতো।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সফল হয়েছে অনেক জীবনের মূল্যে, আহত হাজার হাজার মানুষকে এখনো এক বিভীষিকাময় সময় পার করতে হচ্ছে। এমন আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান অনেক প্রত্যাশার জন্ম দেয়। দ্রুত ফল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়। অথচ একটি রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থান বা এর পরের বাস্তবতা সামাল দেওয়াই এমন পরিস্থিতিতে এক কঠিন কাজ। এখন এর সঙ্গে যদি বাড়তি আশা ও দ্রুত ফল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যুক্ত হয়, তখন হতাশার পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত তেমনই একটি সময় পার করছে যা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া সাক্ষাতকারে।

কাজেই সাধু সাবধান পতিত শক্তি থেকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠুক নতুন শক্তি থেকে। কেননা বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ! কাজেই ছাত্রসমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনী গণ-অভ্যুত্থান সফলকারী পক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নাহলে প্রতিবিপ্লবের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে।