বাঘা বাঘা রাজনীতিকরা ফেল-তেঁতুলিয়ায় নিজামের চমক
তেঁতুলিয়া প্রতিনিধি : পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে এবার চমক দেখিয়েছে ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন।বাঘা বাঘা আওয়ামী লীগের নেতাদের ভিড়ে বিজয়ী হয়েছেন তরুণ ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন খান (৩৩)। কোনো রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁচ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী নিজাম উদ্দিন বিপুল ভোটের ব্যবধানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রার্থী হওয়ার পর তেমন বড় কোনো মিটিং-মিছিল, উঠান বৈঠক কিংবা জাঁকজমক প্রচার-প্রচারণা ছিল না নিজাম উদ্দিনের। তবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়েছেন তিনি। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ মোট পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই ছিলেন জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা। এ ছাড়া বিএনপি ঘরনার অপর এক প্রার্থী ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। এই প্রার্থীদের ভিড়ে প্রথম দিকে নিজাম উদ্দিনকে হিসাবেই ধরেননি অনেকে। কিন্তু বুধবার রাতে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে একে একে যখন ফলাফল আসছিল, তখন অন্য প্রার্থীদের চোখ কপালে ওঠে। সবাইকে তাক লাগিয়ে নবীন প্রার্থীই হাসলেন বিজয়ের হাসি।
৩৩ বছর বয়সী নিজাম উদ্দিন খান তেঁতুলিয়া উপজেলার তীরনই হাট ইউনিয়নের সংকরপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে নিজাম উদ্দিন চতুর্থ। ২০১৪ সালে স্নাতক পাস করে পরের বছর পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হন। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরে কাপড়ের দোকান চালানোর পাশাপাশি তিনি ধান, গম, ভুট্টা ও শুকনা মরিচের ব্যবসা করেন।
নিজাম উদ্দিন খান বলেন, ‘আমি কোনো দিন রাজনীতি করিনি। আর কখনো নির্বাচন করব, এমনটাও ভাবিনি। নির্বাচনে আসার ব্যাপারে ব্যবসায়ীরাই উৎসাহ দিয়েছেন। পরে পরিবারের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে উপেজেলা পরিষদ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছি। অন্য প্রার্থীদের মতো আনুষ্ঠানিক বড় কোনো প্রচার-প্রচারণা ছিল না আমার। কিন্তু আমি ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চেয়েছি। যাঁর কাছেই গেছি, তিনিই বলেছেন, “আমাদের কাছে তো আর কেউ আসেননি। আপনি আসছেন, ভোট দিব আপনাকে।” মানুষ আমার ওপর আস্থা রেখেছেন, বিশ্বাস করেছেন, ভালোবাসা দেখিয়েছেন।’
তেঁতুলিয়া উপজেলাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিজাম উদ্দিন খান বলেন, ‘ভোটে আমার বক্তব্য ছিল খুবই অল্প। মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে আমি শুধু বলেছি, “আমি নিজাম উদ্দিন খান, একজন সাধারণ ব্যবসায়ী। আপনারা উপজেলা পরিষদে আমাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখেন যে আমি আপনাদের জন্য কতটুকু কী করতে পারি। যদি খারাপ করি, তাহলে আমাকে আর পাঁচ বছর পর ভোট দিবেন না।” আমি পাঁচ বছর মানুষের উপকারে কাজ করতে চাই।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পঞ্চগড়ের নেতা রফিকুল ইসলাম ভুট্টো দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, সরকারদলীয় লোকজন নিজস্ব আখের গুছিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করেছেন। ফলে তাঁরা লাভজনক জায়গা ভেবে নির্বাচনে গেছেন। এতে তাঁদের দলীয় প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। আর যিনি জিতেছেন, তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাওয়ায় মানুষ তাঁকে হয়তো বিশ্বাস করেছেন। এটাকে উদীয়মান তারুণ্যের চমক বলা যায়।
তিন আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে কেউই নিজাম উদ্দিন খানের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেননি। তাঁরা জামানত হারাতে যাচ্ছেন। নিজাম উদ্দিন খানের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উপজেলার দেবনগর ইউনিয়ন বিএনপির কার্যনির্বাহী সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়া মো. মুক্তারুল হক।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. এনামুল হক বলেন, নিয়ম অনুযায়ী জামানত বাঁচাতে হলে একজন প্রার্থীকে মোট প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ ভোট পেতে হয়। অর্থাৎ এই উপজেলায় জামানত বাঁচাতে একেকজন চেয়াম্যান প্রার্থীকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার ৪০৪টি ভোট পেতে হবে।
তিন আওয়ামী লীগ নেতার একজন তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান। তিনি পঞ্চগড়-১ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মজাহারুল হক প্রধানের ভাগনে। আরেক প্রার্থী কাজী আনিছুর রহমান উপজেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক এবং তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফরিদা আখতারের ভাতিজা। এ ছাড়া জামানত হারাতে বসা অপর চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল লতিফ তারিন বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহভাপতি এবং পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলামের বেয়াই।
ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিজয়ী চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন ৩৬ হাজার ৮৪০ ভোট পেয়েছেন। অপর দিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী চার প্রার্থী মিলে ভোট পেয়েছেন ৩০ হাজার ৩৬৬ ভোট। আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন শোচনীয় পরাজয়ের কারণ হিসেবে উপজেলার তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা বলেন, একসঙ্গে তিনজন আওয়ামী লীগ নেতা প্রার্থী হওয়ায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। কে কার পক্ষে কাজ করবে, সেটা নিয়েও কর্মী-সমর্থকেরা বিপাকে পড়েছিলেন। এ ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে বলেও মনে করেন তাঁরা।
তীরনইহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দানিয়েল ইসলাম বলেন, নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে একই ইউনিয়ন (তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ) থেকে তিনজন হেভিওয়েট নেতা প্রার্থী হয়েছেন। এ কারণে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কে কার পক্ষে যাবেন, এটা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তিতে পড়েছিলেন। এ সুযোগই কাজে লাগিয়েছেন নিজাম উদ্দিন খান।
তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও শালবাহান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তেঁতুলিয়াবাসীর মধ্যে একটা পরিবর্তনের চাওয়া ছিল। সেটা এবার নীরবে ভোট দিয়ে করেছেন তাঁরা। যিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, তিনি যেহেতু কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, মানুষ তাঁর দোষ-গুণ পাননি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ গ্রুপিং পছন্দ করেন না। এ জন্যই তাঁরা একজন সাধারণ মানুষকেই ভোট দিয়েছেন।
পঞ্চগড় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত বলেন, এ পরাজয়ের পেছনে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিভিন্ন রকম অস্থিরতা কাজ করেছে। সাধারণ ভোটাররা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রার্থী হওয়া নেতাদের জনসম্পৃক্ততার অভাব ছিল বলেও তাঁর মনে হয়েছে। তা না হলে এত ভোটের ব্যবধানে তাঁদের শোচনীয় পরাজয় হতো না। আর একাধিক প্রার্থী হওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা দ্বিধাবিভক্তি তো ছিলই।