বাংলাদেশে জঙ্গি সন্ত্রাসবাদ দমনে সাফল্য অনেক-ইন্টারপোল
বিশেষ প্রতিনিধি : ইন্টারপোল মহাসচিব জার্গেন স্টোক বলেছেন, বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই দেশটি সফলতার সঙ্গে জঙ্গিদের মোকাবেলা করেছে। তিনি বলেন, ইন্টারপোল ১৯০টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করে তাদের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে। এভাবে পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব।
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদসহ আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনের লক্ষ্যে গতকাল রবিবার ঢাকায় শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সম্মেলন। এ সম্মেলন উদ্বোধন শেষে ‘মিট দ্য প্রেস’ সেশনে ইন্টারপোল মহাসচিব এসব মন্তব্য করেন। সকাল দশটায় রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ইন্টারপোল ও পুলিশের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এ ধরনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
তিন দিন ব্যাপী এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, ব্রুনাই, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা ও ভিয়েতনামের পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক।
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান। সম্মেলন উদ্বোধনের পর ২টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম ও সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভয়োলেন্স এন্ড টেররিজম রিসার্চ (আইসিপিভিটিআর) এর অধ্যাপক ড. রোহান গুনারত্ন ।
সম্মেলনে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সরকারের একার দায়িত্ব নয়। তাই বিভিন্ন কমিউনিটি, ধর্মীয় নেতাসহ সবাইকে নিয়ে একত্রে জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করা হচ্ছে। শুধু দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের কাজ নয়, প্রতিবেশী দেশেও যাতে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা ঘাঁটি গাড়তে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে কাজ করছি। এছাড়া জঙ্গিবাদ দমনে জাতিসংঘ গৃহীত বিভিন্ন কৌশলগত সিদ্ধান্তের প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে।
ইন্টারপোল মহাসচিব জার্গেন স্টোক বলেন, এ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ, জঙ্গিবাদ ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিষয়ে আলোচনা হবে। এসব অপরাধ দমনে আলোচনার মাধ্যমে উপায় খুঁজে বের করা হবে। এসব বিষয় নিয়ে পারস্পরিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানের জন্য এ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ইন্টারপোল মহাসচিব আরো বলেন, অপরাধ দমন করে সুরক্ষিত বিশ্ব গঠনে পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করতেই এ সম্মেলনের আয়োজন। শুধুমাত্র দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্যই নয় বরং এই কনফারেন্স সন্ত্রাস দমনে আন্তর্জাতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
‘মিট দ্য প্রেস’ সেশনে রাজনৈতিক অনেক নেতার নামে ইন্টারপোলের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংস্থার মহাসচিব বলেন, রাজনৈতিক কোনও নেতার নাম যদি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় সেক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষ অভিযোগ করলে তা যাচাই-বাছাই করা হয়। যদি প্রমাণ পাওয়া যায় যে রাজনৈতিক বিবেচনায় কারও নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তাহলে তার নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
‘হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়েছিল আইএস’: সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিপিভিটিআর এর পরিচালক প্রফেসর রোহান গুণারত্নে তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, সমগ্র পৃথিবীতে বর্তমানে তিন ধরনের হুমকি বিরাজমান। প্রথমত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হুমকি, দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবাদীদের হুমকি এবং তৃতীয়ত ভাবার্দশগত উগ্রপন্থীদের হুমকি। তিনি বলেন, বর্তমানে সন্ত্রাসবাদের হুমকি বহুজাতিকভাবে দেখা হচ্ছে। যেমন- ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং তার সহযোগী দলগুলো ইসলামী উগ্রপন্থী সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ এর আদলে কাজ করছে। এর ফলে এশিয়া প্যাসিফিক এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রফেসর রোহান জঙ্গিবাদ দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন। পাশাপাশি গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলা সম্পর্কে বলেন, এ হামলা প্রতিরোধে কমান্ডোদের জন্য অপেক্ষা করা ভুল ছিল। হলি আর্টিজানে হামলা দেশীয় ( হোম গ্রোন) জঙ্গিদের নয়, হামলা চালিয়েছিল আইএস। আর নয়া জেএমবির সদস্যরা আইএস মতাদর্শে বিশ্বাসী।
তিনি আরো বলেন, পুলিশ দেখে অপরাধীরা সাধারণত পালায়, কিন্তু জঙ্গিরা মরতে চায়। তাই হলি আর্টিজান দখল করে কোনে ধরনের দর-কষাকষিতে যায়নি জঙ্গিরা। ফলে অভিযানের কাজে পুলিশকে বিশেষ কোনো বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিল না। তবে জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সব গোয়েন্দা সংস্থার একসঙ্গে কাজ করা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
‘কওমী মাদরাসায় জঙ্গিবাদের ধারণা দেওয়া হয়’: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম তার প্রবন্ধে বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে আইএস সদস্য থাকার কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখানে কিছু হোম গ্রোন জঙ্গি রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ সরকার সর্বদাই জঙ্গিবাদ নির্মূলের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করে আসছে। তিনি বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। প্রথমত বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বামপন্থী উগ্রপন্থার উত্থান এবং দ্বিতীয়ত সমসাময়িককালে বিপথগামী ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের দ্বারা সৃষ্ট জঙ্গিবাদ।
দেশে জঙ্গিদের ‘ব্রিডিং গ্রাউন্ড’ (আঁঁতুড় ঘর) হিসেবে কওমী মাদরাসার কথা উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘কওমী মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিকভাবে জঙ্গিবাদের ধারণা দেয়া হয়।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের বেশির ভাগই অতিদরিদ্র ও অভিজাত পরিবারের সন্তান। তারা সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।