বসুন্ধরা বিটুমিন-বঙ্গবন্ধু টানেলের গর্বিত অংশীদার
বিশেষ প্রতিনিধি : দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই টানেল নির্মাণে গর্বিত অংশীদার দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ। বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র বেসরকারি বিটুমিন উৎপাদনকারীও বসুন্ধরা শিল্প পরিবার। বঙ্গবন্ধু টানেলের সড়ক নির্মাণে বসুন্ধরার উৎপাদিত পলিমার মডিফাইড বিটুমিন (পিএমবি) ও পেনিট্রেশন গ্রেড বিটুমিন (৬০/৭০) ব্যবহৃত হয়েছে।
পলিমার মডিফাইড বিটুমিনে করা সড়ক সর্বোচ্চ ৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং সর্বনিম্ন মাইনাস ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়ও কোনো পরিবর্তন হয় না।
(২৮ অক্টোবর) পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল (২৯ অক্টোবর) থেকে টানেলটি যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অর্থনীতি বেগবান হওয়ার পাশাপাশি দেশের যোগাযোগ কাঠামোয় নতুন মাত্রা যোগ হলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত নিম্ন ও উচ্চ তাপমাত্রায় বিটুমিনের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় ১৯৮০ সাল থেকে পলিমার মডিফাইড বিটুমিনের ব্যবহার হয়ে আসছে। ‘স্টাইরিন বুটাডিন স্টাইরিন’ (এসবিএস) নামক একটি বিশেষ ধরনের পলিমার বেইস বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন তৈরি করা হয়। এই বিটুমিন আর্দ্রতা সংবেদনশীল, নিম্ন তাপমাত্রার নমনীয় এবং উচ্চ তাপমাত্রায় শক্ত থাকে। এটি মহাসড়কের উপরিভাগকে সব ধরনের আবহাওয়াজনিত ক্ষতি, ফাটল বা খানাখন্দ তৈরি হওয়া থেকে রক্ষা করে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) জানিয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনসহ বিভিন্ন মহাসড়কে বহুল ব্যবহৃত ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছিল। এতে অনাকাঙিক্ষত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে সওজকে। তাই সওজ এখন তাদের বড় প্রকল্পগুলোতে পলিমার মডিফাইড বিটুমিন ব্যবহার করছে। এদিকে, এই বিটুমিনের চাহিদা বাড়ায় আমদানি নির্ভরতা কমাতে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্বমানের পলিমার মডিফাইড বিটুমিন উৎপাদন শুরু করেছে বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটি তাদের উৎপাদিত বিটুমিন বিদেশেও রপ্তানি করবে।
দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে উন্নয়নসহ এই টানেল আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকেও ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শিল্পায়ন আবাসন ও বাণিজ্যে উন্নয়ন ঘটবে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য বহু আগে থেকে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এক্ষেত্রে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাড়তি জেটি নির্মাণের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ালে আঞ্চলিক ব্যবহারের দ্বারও উন্মুক্ত হয়ে যাবে বলে ব্যবসায়ীদের ধারণা।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের এই টানেল দুদিকে চীন-মিয়ানমার ও ভারত-ভুটানকে এক সুতোয় গেঁথে দিতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এই পাঁচটি দেশকে সড়কপথে এক সুতোয় গাঁথার যে পরিকল্পনা চলছে, বঙ্গবন্ধু টানেল তাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিলো। বিশেষ করে মিয়ানমার হয়ে চীনের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগের চেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। এর মধ্য দিয়ে আসিয়ানভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন আরও সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, টিউবসহ কর্ণফুলী টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা প্রান্তে রয়েছে শূন্য দশমিক ৫৫ কিলোমিটার, আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক রয়েছে। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তের সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার উড়াল সড়কও নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বিটুমিনের শতভাগই বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড থেকে সরবরাহ করা হয়েছে।
নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসেবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টানেল চালু হলে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে ওঠবে নতুন শিল্পকারখানা।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং টানেল প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন। সবশেষ গত বছরের ২৬ নভেম্বর টানেলের প্রথম টিউবের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গ জানতে চাইলে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সচিব ও নির্বাহী পরিচালক মাকসুদুর রহমান বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল” উদ্বোধনের মাধ্যমে আমরা উন্নয়নের এক বৈপ্লবিক মুহূর্ত দেখলাম। এর পেছনে অবশ্যই সবচেয়ে বড় অবদান আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার।
৩.৩২ কি.মি. দীর্ঘ এই টানেল চালুর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে উল্লেখ্য করে তিনি বলেন, এই টানেলের কারণে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর থেকে সারা দেশে আমরা সহজেই পণ্য আনা-নেওয়া করতে পারবো। এতে শিল্পায়নে বিশাল পরিবর্তন আসবে, ব্যবসার পরিধিও বাড়বে। পাশাপাশি বহু মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
তিনি বলেন, টানেলকে গতিশীল করতে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫.৩৫ কি.মি. দীর্ঘ সংযোগ সড়ক তৈরি করতে বসুন্ধরা গ্রুপের ২ ধরণের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। একটা বিশ্বমানের ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন আরেকটি পলিমার মডিফাইড বিটুমিন। আমাদের দেশেই বিশ্বমানের প্রযুক্তিতে তৈরি এবং পৃথিবীর উন্নয়নশীল সবকয়টি দেশে এই মানের বিটুমিনই ব্যবহার হয়।
আমাদের এই বিটুমিন সকল ঋতুর যেকোনো আবহাওয়ার জন্য উপযোগী।দেশে চলমান মেগা প্রজেক্টগুলোতে বসুন্ধরা গ্রুপের বিটুমিন ব্যবহৃত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পেরে বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড নিজেকে গর্বিত মনে করছে।