বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে খলনায়কের ভূমিকায় জাসদ
এস রহমান.ঢাকা: ৭২ থেকে ৭৫ সালে জাসদ কিভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতা করেছিলো তা নিয়ে এখন উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠ।ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল থেকে জাসদের ওপর আক্রমন চলেছে।বলা হচ্ছে ৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে জাসদ খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। যার পরবর্তী প্রেক্ষাপটে নিহত হন বঙ্গবন্ধু।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুর ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। আর এনিয়ে সমালোচনা জমে উঠেছে খোদ আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও সাংবাদিক মহলে।
আওয়ামী লীগ সরকারের এই তথ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন জাসদ নেতারা ৭২ থেকে ৭৫ সালে কিভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীতা করেছিলেন এবং জাতির জনকের মৃত্যুর পর ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে কিভাবে উল্লাস করেছিল বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনে তার বর্ণনা দিতে শুরু করেছেন বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীসহ খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাই।
১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর সেদিন যারা ট্যাংকের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করেছিল তাদের ভোলেননি বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
স্বাধীনতার পর জাসদ ও ন্যাপসহ যাঁরা বাম রাজনীতি করতেন তাদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য হাট-বাজার লুটপাট, ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, সাধারণ মানুষকে হত্যা, আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা এমনকি ঈদের নামাজের জামায়াত শেষে আওয়ামী লীগের এমপিদের হত্যা পর্যন্ত করেন তাঁরা। এ সমস্ত বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল একটাই, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থিতিশীল করা। তারাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। সেই কারণেই একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পেরেছিল।’
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের পর সমালোচনায় আসা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দাবি করে বলেন ‘হাসানুল হক ইনুই বাংলাদেশে প্রথম গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র রাজনীতি শুরু করেছে। এটা ঐতিহাসিক সত্য।’
‘তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে ১৯৭৪ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলীর বাড়িতে গুলিবর্ষণ করতে দেখেছি। কিন্তু গুলিটা প্রথম এই আনোয়ার হোসেন ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বেই শুরু হল। যখন পাল্টা গুলি আত্মরক্ষার্থে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন থেকে এল, তখন আমরা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে শুরু করি। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। কত জন মারা গেছে- তখন জানার সুযোগ ছিল না।’- এমন মন্তব্য করেন, বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
ওই সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিখিল চন্দ্র সাহার বোমায় নিহত হওয়ার ঘটনার বিবরণ দিয়ে তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের জাসদ ছাত্রলীগের নেতা গয়েশ্বর বলেন, ‘৭৪ সালে সরকারের বিরুদ্ধে হরতালের ডাক দেয় জাসদ। সেই হরতালে বোমা ব্যবহারের জন্য বোমা বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় ইঞ্জিনিয়ার নিখিল চন্দ্র সাহাকে। যাত্রাবাড়ির একটি পরিত্যক্ত বাড়ির মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে নিখিল বোমা বানাতে যায়। বোমাতে মিশানো জিনিস কোনটা আগে দিতে হয়, পরে দিতে হয়- এরকম পরীক্সা-নিরীক্ষার মধ্যে হঠাৎ করে তার নিজের হাতের মধ্যে একটা বোমা ফাটে।’
তিনি বলেন, নিখিলের সন্মানার্থে পেট্রোল বোমা বা হাতবোমার নাম রাখা হল ‘নিখিল’। আপনারা তথ্যমন্ত্রীকে (ইনু) জিজ্ঞাসা করবেন, বোমার অপর নাম নিখিল ছিল কি না?”
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও মূখপাত্র ড. রিপন বলেন, ১৯৭২ থেকে ৭৫ এর মধ্যে দেশে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছিল এর জন্য দায়ী ছিল জাসদ। এর অন্যতম নেতা হলেন হাসানুল হক ইনু। ওই সময়ে যা হয়েছিল তা দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে হবে। একই সঙ্গে এর দায়ভার নিয়ে তথ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগের দাবি জানান তিনি।
এদিকে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কারণেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে সামরিক বাহিনী হত্যা করতে সাহস পেয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন- আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম।
বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, জাসদ থেকেই শুরু ক্যাডার রাজনীতি। স্বাধীনতার আগে রাজনীতি ছিল নীতি ও কর্মসূচিনির্ভর। মুক্তিযুদ্ধের আগে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ প্রভৃতি বড় দলে রাজনীতিতে ছিল নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সমন্বয়। ১৯৭২-এ জাসদ গঠিত হওয়ার সময় থেকে রাজনীতিতে ক্যাডার নির্ভরতা শুরু হয়।
তিনি বলেন, কোনো দলে কর্মী ও সমর্থক এক জিনিস আর ক্যাডার আরেক জিনিস। বাংলাদেশে যারা গত ৪০ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন, সামরিক শাসকই হোন আর বেসামরিক নির্বাচিত সরকারই হোন, সবাই অতিমাত্রায় ক্যাডারদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।
জাসদই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পথ তৈরি করে দিয়েছিল-আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের দেয়া এমন বক্তব্যের পর একই ধরনের বক্তব্য শুরু হয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।
এদিকে, এমন প্রেক্ষাপটের পর জাসদের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দীর্ঘ তদন্ত, তদন্ত শেষে আদালতে দাখিলকৃত অভিযোগপত্র, সন্ত্রাসীদের জেরা, আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণে কোথাও বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জাসদের সংশ্লিষ্টতার সামান্যতম বিষয় আসেনি। তারপরও জনাব শেখ ফজলুল করিম সেলিম কর্তৃক এহেন বক্তব্য প্রদান শুধু সত্যের অপলাপই নয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
অন্যদিকে, মহাজোটের ছাতার তলে চক্রান্ত চলছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। মঙ্গলবার জাসদের বিক্ষোভ পূর্ব সমাবেশে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ইনু বলেন, যখন আমরা জঙ্গিবাদ নির্মূল করে যাচ্ছি তখন একটি মহল তা বন্ধ করতে চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আমরা বরদাস্ত করবো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা জঙ্গিবাদ দমন করবো। এছাড়া দলের নেতাকর্মীদের দলবাজি দখলবাজী করতে দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি।