• রোববার , ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ফেসিস্ট হাসিনা স্টাইল-সেনা হেফাজতে যুবদল নেতার লাশে তোলপাড়


প্রকাশিত: ২:২০ এএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২৫ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৫ বার

 

 


স্টাফ রিপোর্টার/ কুমিল্লা প্রতিনিধি :
কুমিল্লায় ফেসিস্ট হাসিনা আমলের স্টাইলে যৌথ বাহিনীর হেফাজতে যুবদল নেতা মো. তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিক্ষুদ্ধ কুমিল্লাবাসী কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সামনে গতকাল যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম হত্যার বিচারের দাবিতে লাশের গাড়ির সামনে নিয়ে মানববন্ধন করে যৌথবাহিনীর বিচার দাবি করেছে। ওদিকে এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন।

তারা বলছে এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পের কমান্ডারকে প্রত্যাহার করেছে সেনাবাহিনী।
এছাড়া উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। গতকাল শনিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে, তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে এ নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে। মৃতের স্বজনরা জানান, মাত্র ছয় দিন আগে তৌহিদুলের বাবা মোখলেছুর রহমান (৮৫) বার্ধক্যের কারণে মারা যান। তার কুলখানির আয়োজন করা হয়েছিল গত শুক্রবার। আর সেই কুলখানির আয়োজন করতেই কর্মস্থল ছেড়ে বাড়িতে ছিলেন তৌহিদুল। তৌহিদুলের মৃত্যুতে শেষ পর্যন্ত তার বাবার কুলখানিও হয়নি। সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে।

তৌহিদুলের স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার বলেন, বিনা অপরাধে আমার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এর পর অমানবিক নির্যাতন করে আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমার অবুঝ মেয়েগুলোকে যারা এতিম করেছে, তাদের বিচার চাই। আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, তা হলে আমরা কেন বিচার পাব না, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

তৌহিদুলের বড় মেয়ে পিতৃহারা তাসফিয়া আক্তার বলেন, আমরা এখন কাকে বাবা বলে ডাকব? আমার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমার ভালো বাবাটাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চার বোন এতিম হয়ে গেছি। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।

এদিকে আইএসপিআর বলেছে, গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের’ ভিত্তিতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা থেকে মো. তৌহিদুল ইসলাম (৪০) আটক হন। পর দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। এই ‘অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক’ ঘটনা তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সেনাক্যাম্পের কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটনে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্তদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পারিবারিক সূত্র জানায়, তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম বন্দরের একটি শিপিং এজেন্টের কর্মী ছিলেন। তিনি কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের পাঁচথুবী গ্রামের মোখলেছুর রহমানের ছেলে এবং ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক। তার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে গত রবিবার বাড়ি আসেন তৌহিদুল।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে- এ ধরনের ঘটনা মানবাধিকার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। রাষ্ট্র কর্তৃক আটক ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আসক এ ঘটনার স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচারিক তদন্ত দাবি করছে এবং দায়ীদের যথাযথ আইনানুগ শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছে। একই সঙ্গে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণ প্রদানে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে।

পৃথক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগের বিষয়টি অনাকাক্ষিত ও অনভিপ্রেত, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।এদিকে গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশে এ ধরনের অমানবিক নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশবাসীর জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।

যুবদল নেতার মৃত্যুতে জড়িত সেনাসদস্যদের বিচার চেয়েছে বিএনপি। এ কাণ্ডে ফেসবুকে পৃথক পোস্ট দিয়েছেন বিএনপি ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।মৃতের স্বজনরা জানান, কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গত শুক্রবার রাত ৮টার দিকে স্বজনরা তৌহিদুলের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন। গতকাল শনিবার জানাজা শেষে সন্ধ্যায় তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ সময় বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

তৌহিদুলের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় কোনো মামলা হয়নি। তার শরীরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক ও স্বজনরা। তবে বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেছেন কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. মহিনুল ইসলাম।

তৌহিদুল ইসলামের ভাই আবুল কালাম দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর ৩টি গাড়ি ও একটি লাল রঙের গাড়ি বাড়িতে আসে। তৌহিদুল ইসলামের কাছে অস্ত্র আছে এমন অভিযোগে তাকে ধরে নিয়ে যায় তারা। এরপর আমার ভাইকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর সদস্যরা যখন আমাদের বাড়িতে তল্লাশি করেন, তখন বারবার বলছিল অস্ত্র কোথায়? ভিত্তিহীন একটি তথ্যে আমার ভাইকে নির্যাতন করে মেরে ফেললেন তারা। আমরা এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও বিচার চাই।

তৌহিদুলের ভগ্নিপতি সোহেল মহিউদ্দিন বলেন, অমানবিক নির্যাতন করে তৌহিদুলকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা তো দূরের কথা, একটা জিডিও ছিল না। আমরা এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা করব। থানায় মামলা না নিলে আদালতে যাব। তৌহিদুলের চারটি মেয়ে এতিম হয়ে গেল।
তৌহিদুলের আরেক ভগ্নিপতি খান-ই-আলম বলেন, বাড়ির পাশের একটি পরিবারের সঙ্গে তৌহিদুলদের জমি নিয়ে বিরোধ আছে। আমরা সন্দেহ করছি তারাই আর্মিকে ভুয়া তথ্য দিয়েছে যে, তৌহিদুলের কাছে অস্ত্র আছে। আমরা পুরো ঘটনার তদন্ত চাই। যারা এর নেপথ্যে ছিল, তাদেরও বিচার চাই।

ওদিকে ঘটনার কঠোর নিন্দা ও দ্রুত তদন্তের নির্দেশ সরকারের যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনায় দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে সরকারের এ নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যে কোনো ধরনের নির্যাতন ও হত্যার কঠোর নিন্দা জানায়। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এ সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, যেখানে দেশের শীর্ষ মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, দেশে এ ধরনের অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে একাধিক কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের বেশিরভাগই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অপরাধ ব্যবস্থাপনা ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমস্ত সুযোগ নির্মূল করতে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ করবে বলে প্রেস উইং জানায়।