ফুটপাত থেকে আড়াই’শ হাজার কোটিপতি-তিনি
প্রিয়া রহমান : অদম্য উদ্যম আর একগ্রতা’র বলে তিনি এখন পৃথিবীখ্যাত বড় শিল্পপতি। অথচ যখন শুরু করেছিলেন তখন তিনি নিজেই ছিলেন শ্রমিক,সেলসম্যান এবং মালিক। তাঁর পরিশ্রমের ফসলে তিনি ফুটপাত থেকে আড়াই’শ হাজার কোটি টাকার মালিক বনেছেন। বহুল আলোচিত এই ব্যক্তির নাম কারসানভাই প্যাটেল। তাঁর অজানা অধ্যায় নিয়েই এই প্রতিবেদন।
শুরুতে দরজায় দরজায় ফেরি করে সাবানের গুড়ো বিক্রি করতেন কারসানভাই প্যাটেল। সময়ের পথপরিক্রমায় সেই কারসানভাই এখন ২ হাজার ৫০০ কোটি রুপির মালিক। শুধু তাই নয়; ২০১০ সালে তাকে ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত করেন। ভারতের উত্তর গুজরাটের নিতান্ত গরীব এক কৃষক পরিবারে জন্ম তার।
রসায়ন বিভাগ থেকে ২১ বছর বয়সে বিএসসি পাশ করে একজন সাধারণ ল্যাব টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তবে এখানকার স্বল্প বেতনে সংসার চালাতে বেশ কষ্ট হতে থাকে তার। তাছাড়া বেতনের টাকা-আসতে সময় লাগে ৩০ দিন; অথচ খরচ হতে সময় লাগে বড়জোড় ৩ থেকে ৪ দিন। তাই নতুন কিছু করার চিন্তা করলেন তিনি। যেই চিন্তা সেই কাজ।
শুরু করলেন নিজের বাড়ির পেছনে কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট তৈরির কাজ। ভদ্রলোকের এহেন খামখেয়ালী কাণ্ড দেখে প্রতিবেশীরা শুরু করলো হাসাহাসি। বাজারে তখন সার্ফের একচেটিয়া দাপট। এ যেন কুমিরের সাথে শোল মাছের যুদ্ধ। মানুষ হাসবে না তো কি করবে? মানুষের হাসি তামাশা যত বাড়লো- তার উদ্দীপনা তত বেশি দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকলো। সারাদিন অফিসে কাজ শেষ করে সারারাত ধরে শুরু হলো হার না মানা পরিশ্রম।
একজন ব্যক্তি, একাই মালিক, একাই শ্রমিক, একাই বিক্রেতা, বলতে গেলে-ওয়ান ম্যান কোম্পানি। অফিসে যাওয়ার পথে সাইকেলে করে ডিটারজেন্ট প্যাকেটগুলো নিয়ে যান। খুবই সস্তা দামে ফেরি করে বিক্রি করার চেষ্টা করেন। কাজ থেকে ফিরে পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝান। কেউ কিনে কেউ ধমক দিয়ে, কেউ বা গালাগালি করে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু তিনি অদম্য। তার তৈরি জিনিসটি ভালো; দামে সস্তা। ১ কেজি পাওডারের দাম মাত্র সাড়ে ৩ রুপি। সেখানে সার্ফের দাম প্রায় ১৬ রুপি। মানুষ কিনবে না কেন?
অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের কোনও একদিন। সারাদিন ছুটি; অফিস নেই। সকালে কাকডাকা ভোরে বের হয়ে রাতে বাসায় ফিরলেন। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিক্রি করলেন মাত্র ১৬ প্যাকেট পাউডার। আর এতেই ভদ্রলোক যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দ পেলেন।
এরপর থেকে ইতিহাস। প্রতিদিন বাড়তে থাকলো বিক্রি। সেদিনের ১৬ প্যাকেট আজ দিনেই বিক্রি হয় প্রায় লাখো প্যাকেট। ১০০ স্কয়ার ফিটের যে ঘরে সারারাত জেগে পাওডার তৈরি করতেন সেই ১০০ স্কয়ার ফিটের আধিপত্য আজ শুধু ভারতবর্ষই নয়-ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এ যেন এক রূপকথার গল্প।
এই গল্পের নায়ক কারসানভাই প্যাটেল। এর মধ্যেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় তার আদরের মেয়ে নিরমা। মেয়ের প্রতি ভালোবাসা আর মেয়েকে অমর করে রাখতে নিজের ব্র্যান্ডের নামও তাই নিরমার নামে ‘নিরমা ডিটারজেন্ট পাওডার’ রেখে দেন ইতিহাসের এই ব্যক্তি। যে ব্র্যান্ডটি আজ তার কাছে মেয়ের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। আজ সেই ব্র্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গে কারসানভাইয়ের মেয়ের নামও ঘোরে সবার মুখে মুখে। ‘সাব কী পাসন্দ নিরমা’।
দরজায় দরজায় ফেরি করে ডিটারজেন্ট বিক্রি করা নিরমার বাবা আজ ডিটারজেন্ট বাজারে ৩৫ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে। ১৯৬৯ সাল থেকে শুরু হয়েছে নিরমার যাত্রা। সেই সময়টায় দেশীয় ডিটারজেন্টের কোম্পানির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলির সঙ্গে লড়াইয়ে প্রথমের দিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল কারসানভাইকে। তবে, বিজনেস স্ট্র্যাটেজিতে নতুন চিন্তাভাবনা প্রয়োগ করে সাফল্যের মুখ দেখেন তিনি।
গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বাজার ধরতে প্রথমে তিনি শুরু করলেন সস্তায় ডিটারজেন্ট বিক্রি। নিজের বাড়ির পিছনে বসে নিজের হাতেই তৈরি করা ডিটারজেন্ট বাড়ি বাড়ি গিয়ে ৩ রুপি কেজি দরে বিক্রি করতেন কারসানভাই। ৮০-র দশকে বিজ্ঞাপনী প্রচারে আলোড়ন ফেলে দেন কারসানভাই। মেয়ে নিরমার সাদা ফ্রক পরা একটি ছবিকে কেন্দ্র করে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে ‘সাব কী পাসন্দ নিরমা’।
নিরমার জিঙ্গল বিক্রি বহু গুণ বাড়িয়ে দেয় এই ডিটারজেন্টের। তাদের সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের সার্ফও তাদের থেকে বেশ কয়েক কদম পিছিয়ে পড়ে। শুধু ডিটারজেন্টই নয়, নিজের ব্যবসাকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন কারসানভাই। লাজুক স্বভাবের এই মানুষটি ১৯৯৫ সালে তৈরি করেন নিরমা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, ২০০৩ সালে তৈরি করেন নিরমা ইউনিভার্সিটি অফ সায়ান্স অ্যান্ড টেকনোলজি।
২০০৪ সালে কারসানভাই লঞ্চ করেন নিরমাল্যাবস এডুকেশন প্রজেক্ট। সেদিনের সাইকেলে চড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে পাওডার বিক্রি করা ছেলেটি ২০০৭ সালে আমেরিকার অন্যতম মেট্রিয়ালস কোম্পানী Searles Valley Minerals Inc. মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেয়। একাই একটি ছোট খুপড়ি ঘরে যে কাজ শুরু করেছিলেন সেখানে এখন প্রতিদিন কাজ করে প্রায় ১৪ হাজার কর্মকর্তা, কর্মচারী। আর সাড়ে তিন রুপির শুরু করা ব্যবসা দাঁড়িয়েছে বর্তমানে ১২.১৭ বিলিয়ন ডলারে। সাইকেলে ক্রিং ক্রিং করে ডোর টু ডোর ডিটারজেন্ট বিক্রি করা সেই কারসানভাই আজ ২৫০০ কোটির মালিক।
পাওডারের গায়ে যে ছবিটি থাকে সে তারই মেয়ে নিরুপমা ডাকনাম ‘নিরমা’। নিরমা নামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন কারসানভাই প্যাটেল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভারতের অন্যতম ফার্মাসি কলেজ- নিরমা ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি।