• বৃহস্পতিবার , ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ফকিরের টাকাও মেরেছে মন্ত্রী


প্রকাশিত: ২:৩৪ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬ বার

০০ টাকা খেয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বোন শালা সমন্ধীও
০০ এপিএসের শ্বশুর–শাশুড়ি-শ্যালকও বাদ যায়নি

 

লাবণ্য চৌধুরী : একেই বলে মন্ত্রীর তেলেসমাতি! নিজে মন্ত্রী ছিলেন বলে দুস্থদের নামে বরাদ্দ সরকারি টাকা অকাতরে বিলিয়েছেন নিজের পরিচিত স্বজনসহ বড়লোকদের মাঝে। মন্ত্রীর লোকজন এতই বুভূক্ষু যে তারা ফকিরের টাকাও মেরে খেয়েছেন। নিজেরা দুস্থও সেজেছেন। সরেজমিনে সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর গ্রামে এসব তথ্য মিলেছে। মন্ত্রীর এলাকার লোকজন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেছেন, শুধু মন্ত্রী যে অপকর্ম করেছেন তা নয় তার এপিএসও দুস্থ’র টাকা খেয়েছে। মন্ত্রীর এপিএসের শ্বশুর–শাশুড়ি-শ্যালকও মেরেছে ফকিরের টাকা, অসহায় মানুষের জন্যে বরাদ্দ রাখা টাকা।

জানা গেছে, ফকিরের টাকা খেয়েছেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বোন নূরন নাহার আনোয়ারও। তাঁর স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। অথচ দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের বিশেষ অনুদানের (ব্যক্তি পর্যায়ে) টাকা বেমালুম মেরে দিয়েছেন। অসহায় ব্যক্তিদের তালিকায় নূরন নাহারের নাম আছে। শুধু নূরন নাহার নয়, তাঁর মেয়ে জামাতা মোহাম্মদ জাভেদ চৌধুরীরও নাম আছে তালিকায়। যদিও জাভেদ একটি মুঠোফোন কোম্পানির কর্মকর্তা ছিলেন। বর্তমানে তাঁরা উভয়ই কানাডায় আছেন। জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের তথ্য বলছে, এই দুজনের নামেই ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থসহায়তা দেওয়া হয়েছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ। এই প্রতিষ্ঠান দুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিদের চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও গৃহ মেরামত বাবদ সহায়তা দেয়। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লালমনিরহাট জেলার ১ হাজার ৬৩১ জন ব্যক্তিকে ২ কোটি ৫০ লাখ ৯২ হাজার টাকা বিশেষ অনুদান দেওয়া হয়েছে।

নুরুজ্জামান আহমেদ ২০১৬ সালে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সালে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০২৪ সালের মন্ত্রিসভায় তিনি বাদ পড়েন। তিনি ২০১৪ সাল থেকে লালমনিরহাট-২ (কালীগঞ্জ-আদিতমারী) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০২১-২২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায় কালীগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চনশ্বর গ্রামে নুরুজ্জামান আহমেদের স্ত্রীর ভাতিজা গোলাম মোস্তফা, গোলাম ফারুক, আবু সাঈদ খান, আবু জাফর খানসহ তাঁদের পরিবারের ১৬ ব্যক্তির নাম রয়েছে। এ অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা পেয়েছেন তাঁরা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও গোলাম ফারুকদের পরিবারের ১০ সদস্য আবার সহায়তার টাকা পান।

গোলাম ফারুক অবশ্য তালিকায় নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামের বিষয়টি জানেন না বলে মুঠোফোনে দাবি করেছেন। তবে কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সদ্য বিদায়ী কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক তাঁদের টাকা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কালীগঞ্জের তুষভান্ডার ইউনিয়নের সদস্য রাকিবুল ইসলাম বলেন, সাবেক মন্ত্রী তাঁর আত্মীয়স্বজনকে তুষ্ট করে দরিদ্র মানুষকে বঞ্চিত করেছেন।

আর নূরন নাহার আনোয়ার ও জাভেদ চৌধুরী সপরিবার কানাডায় থাকায় হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেও তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে নূরন নাহারের ছোট ভাই কালীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাহাবুবুজ্জামান আহমেদ বলেন, তাঁরা (বোন ও ভাগনি জামাই) ভালো মানুষ। অন্য কেউ হয়তো তাঁদের নাম ব্যবহার করেছেন।

দুস্থ’র টাকা খেয়েছে এপিএসের শ্বশুর–শাশুড়ি-শ্যালক

কালীগঞ্জের তুষভান্ডার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তালেব আলবানী সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিবের (এপিএস) শ্বশুর। আবু তালেবসহ তাঁর স্ত্রী মুসারত রেহেনা ও ছেলে ফুয়াদ হাসানের নাম আছে ২০২১–২২ অর্থবছরের অনুদানপ্রাপ্তদের তালিকায়। জানতে চাইলে আবু তালেব মুঠোফোনে বলেন, তাঁদের নাম অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে।

তবে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা গ্রামের আশিক বাবু ভিন্ন বক্তব্য দেন। তিনি এপিএস মিজানুর রহমানের চাচাতো ভাই। তাঁর নামও আছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে অনুপ্রাপ্তদের তালিকায়। আশিকের দাবি, এপিএস মিজান তাঁর কাছ থেকে একটি মাদ্রাসার নিয়োগ বাবদ ৭ লাখ টাকা নেন। কিন্তু চাকরি না হলে অনুদানের দুটি চেক দিয়ে এক লাখ টাকা ফেরত দেন।

আদিতমারীর মহিষখোচা ইউনিয়নের দেলজার রহমানের নামে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ হলেও তিনি সেই টাকা পাননি। দেলজারের দাবি, এপিএস মিজানুরের মামা সেকেন্দার আলী তাঁকে দিয়ে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংকে হিসাব খুলে নেন। কিন্তু পরে টাকা পাননি। দেলজারের মতো অন্তত ২০ জন বলেছেন, তালিকায় তাঁদের নাম থাকলেও টাকা পাননি।

অভিযোগের বিষয়ে সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও তাঁর এপিএসের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁরা আত্মগোপনে গেছেন।এই অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের আরও ঘটনা রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা লিটন মিয়ার শ্বশুর মোহাম্মদ হোসেন, তাঁর শাশুড়ি, স্ত্রী ও স্ত্রীর চার বোন গত তিন অর্থবছরে প্রায় দুই লাখ টাকা পেয়েছেন। যদিও লিটনের শ্বশুর কালীগঞ্জের দক্ষিণ দলগ্রামে মোহাম্মদ হোসেন একজন সচ্ছল কৃষক। দুস্থদের টাকা তাঁর স্ত্রী কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে লিটন মিয়া বলেন, তাঁর স্ত্রী ‘অসুস্থ’ থাকায় এই টাকা নেন।

কালীগঞ্জের গোপাল রায় গ্রামের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা ইনসানা বেগম ও তাঁর স্বামী জেলা যুবলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মনজু আলী শেখ ২০২১-২২ অর্থবছরে দুবার করে মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পান। ইনসানার দাবি, তাঁর শ্বশুর ক্যানসার রোগী হওয়ায় তাঁরা এই টাকা পেয়েছেন। তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, দুস্থ নন, শুধু দলীয় পরিচয়ে এমন শতাধিক ব্যক্তি অনুদান পেয়েছেন।

ভিক্ষুকের টাকা লুটপাট-

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ও গরিব, অসহায় ব্যক্তিদের জন্য জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ ২০২০-২১, ২০২১-২২ ও ২০২২–২৩ অর্থবছরে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজকল্যাণ কমিটিকে ১ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়।এই কমিটির সদস্যসচিব ও সাবেক উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাকের (৪ সেপ্টেম্বর তিনি রংপুরের পীরগঞ্জে বদলি হয়েছেন) দাবি,

৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা দিয়ে মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনার জন্য এবং ৮ লাখ টাকা ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ব্যয় হয়েছে। বাকি বরাদ্দ গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।কিন্তু অন্তত চারটি মাস্টাররোল ঘেঁটে কোনো সুবিধাভোগীকে পাওয়া পায়নি। কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতাভোগীদের নাম দিয়ে এই ভুয়া মাস্টাররোল করা হয়।

এদিকে সমাজকল্যাণ পরিষদের বণ্টন মাস্টাররোলসহ যাবতীয় নথিপত্র হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে ৫ সেপ্টেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন অফিস সহকারী পারভীন বেগম। ওই অফিসে কর্মরত একজন ইউনিয়ন সমাজকর্মী বলেন, ‘দুর্নীতির’ প্রমাণ না রাখতে সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক ও অফিস সহকারী পারভীন বেগম (সদ্য বদলি হয়েছেন) নথি হারানোর ঘটনা সাজিয়েছেন।এ বিষয়ে জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নির্বাহী সচিব শহিদুল ইসলাম বলেন, অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে জেলা সমাজকল্যাণ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।