এইডা কোন দ্যাশে আইয়্যা পড়লাম-‘আমাগো ছেলেমেয়েরে মাইরা হেরা রাজনীতি করব? ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ নাসির মিয়া এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। চোখের সামনে বিছানায় শুয়ে বড় ছেলে আরমান হোসেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। গতকাল শনিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বাসে ছুড়ে মারা পেট্রলবোমায় আরমান পুড়ে যান।
বৃদ্ধ বাবা নাসির মিয়া বলেন, ‘নিজেগোর মারামারির জেরে তারা বোমা মারে। যে ফ্যামেলিরে মারতাছে সেই ফ্যামেলি তো শেষ। সরকার বিহিত না করলে মরণ ছাড়া তো আর পথ নাই।’ পাশে দাঁড়ানো আরমানের বৃদ্ধ মা কোনো কথাই বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ‘আমি আর কী কইমু।’ ছেলে জানে বেঁচে গেছেন, এর জন্য শুকরিয়া জানালেন।
গতকাল রাতে আরমানের মতোই দুর্ভাগ্যের শিকার হন কনস্টেবল মোরশেদ আলম। মৎস্য ভবনের কাছে পুলিশের একটি বাস লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা পেট্রলবোমা ছোড়ে। বাসটি চালাচ্ছিলেন মোরশেদ। বাসটিতে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। আগুনে দগ্ধ মোরশেদ এখন বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। তাঁর মাথার চুল পুড়ে গেছে। বাঁ চোখ খুলতেই পারছেন না। বাঁ হাতও আগুনে পুড়ে গেছে।
মোরশেদ আলম বলেন, ‘সারা দিনের ডিউটি শেষ করে ফিরতেছিলাম। বাইকে করে এসে একটা বাচ্চা ছেলে বাসের সামনে কিছু ছুড়ে মারে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। সারা গাড়ি অন্ধকার। আমি নিয়ন্ত্রণ হারাই। দরজা তো আর দেখা যায় না। লাফ দিছি, মাটিতে গড়াইছি। ফুটপাতের এক নারী টেনেটুনে আমার গায়ের জ্যাকেট খুলে দেন। চারপাশ থেকে সবাই বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করতাছে। কিন্তু কে কারে বাঁচাইব?’ মোরশেদের স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে ময়মনসিংহে বেড়াতে গেছেন। স্বামীর এই দুর্ভাগ্যের খবর পেয়েছেন তাঁরা। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে ঢাকায় ফিরতে পারছেন না।
বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শংকর পালের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৮ নভেম্বর (হরতালের আগের দিন) থেকে আজ রোববার পর্যন্ত সহিংসতার শিকার মোট ৩২ জন ভর্তি হয়েছেন। আজ পর্যন্ত ভর্তি আছেন ১৭ জন। বার্ন ইউনিটে আনার পথে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনজন।
আজ রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বার্ন ইউনিটের বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকা চারজন রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই গতকাল অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন।
আরমান পেশায় ট্রাকচালক। সারা দিন চালানোর পর গতকাল রাতে ট্রাক আমিনবাজারে রাখেন। গাবতলী থেকে বাসায় ফেরার জন্য বাসে ওঠেন। মোহাম্মদপুরে পৌঁছানোর পর সেই বাসে পেট্রলবোমা ছোড়া হয়। তাঁর ১০ ও ৮ বছর বয়সী দুই ছেলে। সামনের মাসে আবার বাবা হবেন আরমান। সংসারের সবার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে প্রতিদিন কাজে বের হতেই হয় আরমানকে। তিনি বলেন, ‘অবরোধের কারণে মনে ভয় ছিল, কিন্তু না বাইর হইলে পেট তো চলে না।’ গতকাল রাতের কথা মনে করে বলেন, ‘আমার চেহারা তো ভালো আছে। আমার সঙ্গে সেদিন বয়স্ক এক লোকরে দেখি পুইড়া চেহারা ভচকাইয়্যা গেছে। কিন্তু তারে আর কী বাঁচাইমু, নিজেই তো বাঁচি না।’
৭০ বা তার বেশি বয়স হবে আবু তাহেরের। স্ত্রীর ভাঙা পায়ের চিকিৎসা করতে পাবনা থেকে অবরোধের মধ্যেই ঢাকায় রওনা হয়েছিলেন। মোহাম্মদপুরে বাস আসার পরেই আগুন লাগে। আবু তাহেরের মুখ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে ফুলে গেছে। তিনি কথা বলতে পারছেন না। পাশ থেকে বড় ছেলের বউ রেহানা জানালেন, একই বাসে থাকা তাঁর দুই দেবরের একজনের হাত পুড়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে আরেকজনের পা ভেঙে গেছে। শাশুড়ির তো আগে থেকেই পা ভাঙা। ছেলেরাই আবু তাহেরের সংসারে উপার্জনক্ষম। তাঁরা সবাই আহত হওয়ায় খরচ নিয়েও চিন্তিত রেহানা। আবু তাহেরের মেয়ে মর্জিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে জানতে চান, তাঁর বাবা ও ভাইদের কী অপরাধ ছিল। এখন তাঁরা কীভাবে চলবেন? এ ধরনের ঘটনার বিচার চান মর্জিনা।
কাপড় বিক্রি করে দিন চলত রায়েরবাজারের বাসিন্দা নূরজাহানের। গতকাল রাতে মোহাম্মদপুরে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা ওই বাসের যাত্রী ছিলেন তিনিও। দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে ঋতু ও দেড় বছরের ছেলে রিফাতকে নিয়ে ওই বাসে যাচ্ছিলেন নূরজাহান। ছেলেমেয়েরা ভালো থাকলেও মা নূরজাহানের সারা মুখ পুড়ে গেছে।
মায়ের পাশে বসা কিশোরী ঋতুর চোখেমুখে আতঙ্ক। কাঁদতে কাঁদতে ক্ষুব্ধ ঋতু বলল, ‘তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তারা গন্ডগোল করে, আর আমরা পুইড়া মরি। সাধারণ মানুষ কেন ক্ষতিগ্রস্ত হইব।’
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা সামন্ত লাল সেন বলেন, শীতের সময় এমনিতেই দগ্ধ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। এখন হরতাল অবরোধে সেই চাপ আরও বেড়েছে। এখানে যারা আসছে, তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে খুব যে ভালো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে তা-ও নয়। ১৮-১৯ দিনের মাথায় যে রোগীরা মারা যাচ্ছে, তারা সংক্রমণে মারা যাচ্ছে। রংপুরের অগ্নিদগ্ধ রোগীকে ঢাকায় আনতে হচ্ছে। সরকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পর্যাপ্ত জনবল দিয়ে বার্ন ইউনিট খুলতে হবে।
সামন্ত লাল সেন আরও বলেন, ‘পাঁচজন পোড়া রোগীর জন্য একজন নার্স প্রয়োজন। আমাদের এখানে ৭০ জন রোগীকে দেখছেন একজন নার্স। বছরে প্রায় সাত লাখ মানুষ পুড়ছে, সেখানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দক্ষ চিকিৎসক আছেন ৫০ জনের মতো। অথচ চিকিৎসক দরকার এক হাজার ৫৫১ জন।
৩০০ শয্যার বার্ন ইউনিটে আজ মোট রোগী ভর্তি আছেন ৪৯২ জন। হরতাল, অবরোধে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের দেখতে যাচ্ছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মী ও রোগীর সঙ্গে থাকা আত্মীয়স্বজনের ভর সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সরা।