`পেট্রলবোমা মেরে মানুষ পোড়ানো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নয়’
একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য সংলাপ শুরুর দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ এবং ক্ষণে ক্ষণে হরতাল কর্মসূচি এগিয়ে চলেছে প্রায় এক মাস যাবৎ। এটাকে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি বলে খালেদা জিয়া এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতারা যতই গলাবাজি করুন না কেন, পেট্রলবোমা মেরে পৈশাচিক কায়দায় পথেঘাটে মানুষ খুনের ও মানুষ পোড়ানোর মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির এই চরম জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস কোনো বিচারেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিবেচিত হতে পারে না।
বিএনপির নেত্রী নিজেকে গুলশানের কার্যালয়ে অবরুদ্ধ রাখার নাটক চালিয়ে তাঁর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টির প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন, আর সুদূর লন্ডনে বসে তাঁর ছেলে তারেক রহমান রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে। লন্ডন থেকে টেলিফোনের আদেশে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অনেকের অভিযোগ।
জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডার ও ভাড়াটে বোমাবাজরাই পেট্রলবোমা মেরে মানুষকে অঙ্গার বানানোর মাঠপর্যায়ের প্রধান হুকুমবরদার। জামায়াত-শিবির তাদের ঘোষণামতো ২০১৩ সালের ‘গৃহযুদ্ধ’ আবার শুরু করেছে। মাঝখানের এক বছর শেখ হাসিনাকে বোকা বানিয়ে তারা হারানো শক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধবিরতি পালন করেছিল মাত্র। সরকার ভেবেছিল, জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের রাজপথের তাণ্ডব ব্যতিরেকে বিএনপির যাবতীয় আন্দোলন-সংগ্রাম যেহেতু মাঠে মারা যাচ্ছে, তাহলে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতি ঘাতক-শিরোমণিদের দণ্ড বাস্তবায়নে কালক্ষেপণের মাধ্যমে ওই গোপন সমঝোতায় আসা তাদের জন্য স্বস্তিকর হবে। আমি বারবার বলে চলেছি যে এই অপকৌশল আখেরে সরকারের জন্য বুমেরাং হতে বাধ্য, কারণ বিএনপি-জামায়াতকে এভাবে আলাদা করে ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই দুই দলের রাজনৈতিক দর্শনে যেহেতু মিল রয়েছে, তাই সাময়িক কৌশল হিসেবে মাঠে-ময়দানে কিছুদিন জামায়াত-শিবির নিজেদের গুটিয়ে রাখলেও যথাসময়ে তারা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবেই।
গত এক মাসের চোরাগোপ্তা হামলায় বিএনপি নেতারা টাকার জোরে যেমনি ভাড়াটে বোমাবাজ ব্যবহার করছেন—তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে—তেমনি ক্রমেই জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের আবার সক্রিয় হওয়ার আলামতও মিলছে, বিশেষত দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোয়। জামায়াত-শিবিরের এহেন তাণ্ডব আগামী দিনগুলোয় আরও চরম আকার ধারণ করবে বলেই আমার আশঙ্কা। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশ মোতাবেক বিএনপির নেতা-কর্মীরা ‘কৌশলী অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন’ বলে বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস গত ৩০ জানুয়ারি তাঁর গোপন আস্তানা থেকে বিবৃতি দিয়েছেন।
আরেক বিবৃতিবিশারদ নেতা রুহুল কবির রিজভীকে বারিধারার গোপন আস্তানা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ওই ৩০ জানুয়ারি রাতে। একই রাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ের বিদ্যুৎ-সংযোগ কেটে দিয়েছিল ডেসকো, যদিও ১৯ ঘণ্টা পর তা পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়েছে। ব্রডব্যান্ড ও ডিশ/কেবলের সংযোগ এখনো পুনঃস্থাপিত হয়নি। বোঝাই যাচ্ছে, দুই নেত্রীর জেদাজেদির এই মহারণে পুড়ে বাংলাদেশটা ছারখার না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা রণে ভঙ্গ দেবেন না। মনে হচ্ছে, দেশ জাহান্নামে গেলেও তাঁদের কিছু আসে-যায় না, ক্ষমতার মসনদের লোভ দুজনকে পুরোপুরি অন্ধ করে দিয়েছে। মানুষকে পুড়িয়ে লাশ বানানোর এই মধ্যযুগীয় বর্বরতা কত দিন চলবে?
অথচ এক বছর ধরে বিশ্বের সর্বত্র অন্যতম প্রধান আলোচনা-বিশ্লেষণের ফোকাস ছিল বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের গাথা। বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের উত্তরণের সম্ভাবনাকে এখন আর অবাস্তব কল্পনা
বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, অনেক উন্নয়ন-বিশেষজ্ঞের কাছে দুর্জ্ঞেয় মনে হলেও সবাইকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা সঞ্চারিত হয়েছে, তাতে বিশ্বের ‘নিম্ন-মধ্যম মাথাপিছু আয়ের’ দেশ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলো পূরণের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে বাংলাদেশ।
এই গতিশীলতা অর্জনের পেছনে যে পাঁচটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, সেগুলো হচ্ছে: ১. বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনে, বিশেষত ধান উৎপাদনে চমকপ্রদ সফলতা, ২. রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের দ্রুত বিকাশ, ৩. বিদেশে অভিবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্স-প্রবাহের প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধির হার, ৪. অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণের কনসেপ্টটি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে গ্রামীণ ব্যাংক ও এনজিওগুলোর ব্যাপক অংশগ্রহণে ক্ষুদ্রঋণের দ্রুত বিস্তার এবং ৫. ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির প্রশংসনীয় অগ্রগতি। বাংলাদেশের অর্থনীতির সাফল্যের এই পাঁচটি প্রধান ডাইমেনশনের কোনটা বেশি কৃতিত্বের দাবিদার, তা নিয়ে বেফজুল বিতর্কের অবতারণা করা আমার কাছে একেবারেই অপছন্দনীয়। কিন্তু যে কথাটা নির্দ্বিধায় বলা চলে তা হলো, এসব অর্জনের প্রতিটির মূল নায়ক বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগণ। তবে সরকারকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। সে জন্য যখন কিছু কিছু বিদেশি খ্যাতনামা উন্নয়ন-চিন্তাবিদ বাংলাদেশের অর্জনকে ‘প্যারাডক্স’, রহস্যজনক বা অবিশ্বাস্য বলে মন্তব্য করে বসেন এবং আমাদের দেশের কিছু কিছু নামজাদা অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞকে তাতে সায় দিতে দেখি, তখন আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। কারণ, এই চমকপ্রদ অর্জনগুলোর পেছনে কোনো রহস্য নেই, কিংবা এ ক্ষেত্রে কোনোই প্যারাডক্স নেই।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট এবং দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের প্রবল তাণ্ডব সত্ত্বেও এই ইতিবাচক প্রবণতাগুলো ক্রমেই জোরদার হয়ে চলেছে। এর মানে হলো, যদি এ দেশের শাসকমহল ও আমলাদের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যেত এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে কিছুটা স্থায়িত্ব দেওয়া যেত, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে এত দিনে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে পারত। ছয় বছর ধরে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আমলে অর্থনীতির এই ইতিবাচক প্রবণতাগুলো সারা বিশ্বের নজরে এসেছে এবং উন্নয়ন-চিন্তাবিদদের সপ্রশংস আলোচনা-বিশ্লেষণের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব মিডিয়াতেও ক্রমেই বাংলাদেশের এই সাফল্যগুলোর বর্ণনা প্রচারিত হচ্ছে। কারণ, যে বাংলাদেশকে একটা ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের লীলাক্ষেত্র হিসেবে সারা বিশ্ব চিনতে অভ্যস্ত ছিল, সেই দেশের এহেন সাফল্য বিশ্বের তাবৎ জনগণের কাছে অবিশ্বাস্য সুসংবাদ হিসেবে বিবেচিত হওয়াই স্বাভাবিক।
বর্তমান সরকার আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলে এই সাফল্যের কৃতিত্ব তাদের ভাগে যাবেই, সেটাই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিশেষ মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে। কারণ, সে ক্ষেত্রে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের পক্ষে যে জনপ্রিয়তার প্রবল জোয়ার পরিদৃষ্ট হয়েছিল, তা আর বেশি দিন নাও থাকতে পারে। বোধগম্যভাবেই তাঁরা আর শেখ হাসিনাকে সময় দিতে চাইছেন না। বর্তমান সংকট যতই দীর্ঘস্থায়ী হবে, তাঁদের পছন্দসই তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও স্বাভাবিকভাবেই বাড়তে থাকবে। এটাই তাঁদের হিসাব-নিকাশ। কিন্তু তাঁদের এই চাওয়া পূরণ হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। ২০১৩-১৪ সালেও এটাই ছিল তাঁদের কৌশল, এবারও ওই খায়েশ চরিতার্থ করতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। কারণ, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে ওটা কোনো সমাধান হতে পারে না, মারাত্মক বিপর্যয়কর সংকটই শুধু ডেকে আনবে।
অতএব, এভাবে দুই পক্ষের এই অন্ধ একগুঁয়েমি আর দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া যায় না। বিএনপি-জামায়াতের মানুষ পোড়ানো ও বোমাবাজির এই সহিংস তাণ্ডবে দেশের সাধারণ জনগণের সহযোগিতা মিলবে না, এটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তাঁদের এই প্রাণঘাতী খেলা অচিরেই গুটিয়ে নেবেন বলে মনে হয় না। তবে পানি-গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা খাদ্য সরবরাহ আটকে দিয়ে খালেদা জিয়াকে তাঁর কার্যালয় থেকে বিতাড়নের যেসব কৌশলের কথা মন্ত্রী ও নেতাদের মুখে শোনা গেছে, তা কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না। এ ধরনের কোনো উদ্যোগ বরং তাঁর প্রতি সহানুভূতি আরও বাড়িয়ে দেবে; তাতে হিতে বিপরীত হবে। কার্যালয়ে টিকতে না পারলে অন্যত্র ঘাঁটি গেড়ে খালেদা জিয়ার পক্ষে এই মানুষ পোড়ানোর খেলা অনির্দিষ্টকাল চালিয়ে যাওয়া তেমন কঠিন নাও হতে পারে; এতে বরং তাঁর ‘আপসহীন’ নেত্রীর ইমেজ বাড়তে থাকবে।
আর মানবিক সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতার ব্যাপারে তাঁর ঔদাসীন্য নতুন কোনো বিষয় নয়, এটা তাঁর আচরণে প্রায়ই প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সাধারণ জনগণ এই মরণযজ্ঞের অসহায় শিকার হচ্ছে জেনেও তাঁর কোনো মানবিক সহমর্মিতা জাগ্রত হবে, কিংবা তিনি বিবেকের দংশন অনুভব করবেন, তা মনে হয় না। অপর দিকে শেখ হাসিনাও যদি প্রতিপক্ষের এহেন অন্যায় জবরদস্তির
কাছে নতিস্বীকার করেন, তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
অতএব, উভয় পক্ষের মুখ রক্ষার খাতিরে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে। আর এই ভূমিকা পালন করতে দুই পক্ষের গোপন সম্মতিতে তাঁরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটি পদক্ষেপ আহ্বান করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি তাঁদের বঙ্গভবনে আলোচনার জন্য দাওয়াত দিতে পারেন। দাওয়াত পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে খালেদা জিয়া অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করবেন। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা উভয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করার পর একাদশ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারসম্পর্কীয় সংলাপ শুরু করার নীতিগত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে, বিএনপির নেতাদের মুক্তি দেওয়া হবে এবং সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর আরোপিত বাধানিষেধ প্রত্যাহার করা হবে। আমার এই প্রস্তাব কি দুই নেত্রী বিবেচনা করে দেখবেন?
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।