‘পঁচাত্তরের অপশক্তি ষড়যন্ত্র করছে’
বিশেষ প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পঁচাত্তরে যে শক্তি ষড়যন্ত্র করেছিল, সেই শক্তি এখনও ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তবে সব প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ তিনবার সরকার গঠন করেছে বলেই বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি একথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘এটা এমনি এমনি হয়নি। যে শিক্ষা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে-দেশকে ভালোবাসা, দেশের কল্যাণে কাজ করা, দেশের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করা, দেশের জন্য যেকোন ঝুঁকি নেয়ার মত সাহস রাখা-একজন রাজনীতিকের জীবনে যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশ বললে কী হতো -বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দুর্ভিক্ষ, দেশের মানুষের কোনো আশা নাই ভরসা নাই এই দেশ স্বাধীনই থাকবে না এরকম একটা চিন্তা ভাবনা বিদেশের মানুষের মনে ছিল। এভাবেই সকলের কাছে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এটাই ছিল সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য।তিনি বলেন, ‘২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট তারা কী করেছে- আমার মাকে তারা হত্যা করেছে। আমার ভাই কামাল-জামালকে হতা করেছে। তাদের নবপরিনিতা বধূ সুলতানা-রোজী তাদেরকে হত্যা করেছে। ছোট ১০ বছরের রাসেলকেওতো রেহাই দেয়নি। তাকেও তো তারা হত্যা করেছে।তিনি বলেন, একই দিনে আমার তিন ফুপুর বাড়িতে আক্রমণ করে পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। একই সময়ে তিনটি বাড়িতে আত্রমণ করে এই হত্যাযজ্ঞ তারা ঘটায়। যেন এই রক্তের কেউ না থাকে।
আওয়ামী লীগ তাকে সভাপতি নির্বাচিত করায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি নির্বাচন করে, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে আসবো। তখন একটা জনমত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবেও সৃষ্টি হয় মানুষের মাঝে একটা উদ্দীপনারও সৃষ্টি হয়। অনেক বাঁধা দিয়েছিল তবু আমি দেশে ফিরে আসি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া, খালেদা জিয়া, এরশাদ সকলেই জাতির পিতার খুনিদের মদদ দিয়েছে। ভোট চুরি করে তাদের সংসদে বসিয়েছে। তাদেরকে নানাভাবে উৎসাহ যুগিয়েছে।তাকে মানসিক আঘাত দিয়ে পর্যুদস্থ করার জন্যই ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো এসব করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি এটাও বুঝি আমাকে আঘাত দেয়ার জন্য বা আমি যেন ভেঙ্গে পড়ি সেইজন্য। কিন্তু আমি কোন বাবার মেয়ে কোন মায়ের মেয়ে এটা তারা উপলদ্ধি করতে পারেনি।
তিনি বলেন, এত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করেও আজকে আওয়ামী লীগ তিনবার সরকার গঠন করেছে বলেই বাংলাদেশ আজকে এগিয়ে যাচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন একটু ভালো কাজ হয়, মানুষ যখন একটু ভালো থাকে তখন সবসময় এটাই মনে হয় যে, আমার বাবা-মা’র আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পাবে, তাদের দেশের গরিব মানুষগুলি একটু ভালো আছে।
তাই, আমরা সবসময় এটাই চেষ্টা করি যে, যখনই কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক হয়-আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ আমাদের সমস্ত সহযোগী সংগঠনের নেতাকমীর্দের উদ্বুদ্ধ করি এসব দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাদের সেবা করার জন্য। এটাইতো আওয়ামী লীগের কাজ এটাইতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ। সেই আদর্শ নিয়েইতো আমাদের তৈরি হতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট আমরা সব হারিয়েছি। বাংলাদেশটাকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। সন্ত্রাস, খুন, জঙ্গিবাদের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল। আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে দেশের মানুষ মারা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক নেতা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে সেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না বলেও উল্লেখ করেন।
মানুষের কল্যাণেই রাজনীতি, মানুষের ধ্বংসের জন্য নয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩, ১৪ এবং ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের সীমাহীন সন্ত্রাস ও নৈরাজের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।তিনি বলেন, এসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেও আজকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাবে কারণ জাতির পিতার এত ত্যাগ, আমার মা’য়ের এত ত্যাগ, আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা যে জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন এবং জনগণের যে আকাঙ্খা, জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণেই বলে গেছেন ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।
জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই আমাদের চলতে হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগকে এটাই বলবো যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সব সময় বলতেন- ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালীর ইতিহাস।’ কাজেই ওই কথাটা যেন ছাত্রলীগ কখনো ভুলে না যায়।
তিনি বলেন, ছাত্রলীগের মূল মন্ত্র শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি- কাজেই এই শিক্ষাটাই হচ্ছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি কর্মীকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তাহলেই এদেশকে আমরা গড়ে তুলতে পারবো।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে আসতে হলেও শিক্ষা একান্তভাবে দরকার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারণ অশিক্ষিত নেতৃত্ব দায়িত্ব পেলে দেশের কী সর্বনাশ হতে পারে তাতো আমরা দেখেছিই। তারা মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারে, লুটপাট করতে পারে, দুর্নীতি করতে পারে, মানি লন্ডারিং করতে পারে, নিজেদের বিত্ত-বৈভব গড়তে পারে। কিন্তু দেশের মানুষকে কিছু দিতে পারে না। কাজেই ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে শিক্ষিত হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের প্রতিটি আন্দোলন- সংগ্রামে এবং অর্জনে ছাত্রলীগের বিরাট অবদান রয়েছে এবং এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালে। যথন আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা।
শেখ হাসিনা বলেন, জিন্নাহ বেঁচে থাকতে তখনই একটা ষড়যন্ত্র হয়েছিল যে, মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে। যেটা আমাদের জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। তমুদ্দুন মসলিস এবং অন্যদের নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তারা গড়ে তোলেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রথম ভাষা দিবস পালন করা হয়।প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ছায়াসঙ্গী হিসেবে তার মায়ের অন্যান্য অবদানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার মায়ের অনন্য ভূমিকা রয়েছে।
তিনি একাধারে যেমন সংসার সামলেছেন, রান্না-বান্না করে সবাইকে খাইয়েছেন, ছেলে-মেয়ে মানুষ করেছেন অন্যদিকে কারাগারে থাকার সময় দল কীভাবে চলবে তার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। নিজের গয়না, বাড়ির ফার্নিচার বেঁচে সংগঠনের টাকা যুগিয়েছেন। অনেক নেতাকর্মীর বাসার বাজারের টাকাও তিনি যোগাতেন, যেমন খন্দকার মোস্তাক।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আমার মা কোর্টে যেমন বঙ্গবন্ধুর মামলার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতেন তেমনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দলের যোগসূত্রটাও তিনিই রক্ষা করতেন। মায়ের যেমন কোনো চাহিদা ছিল না তেমনি বাবার বিরুদ্ধে কোনো অনুযোগও ছিল না, বরং সব সময় ছিল অকুন্ঠ সমর্থন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধু যেন প্যারোলে মুক্তি না নেন এবং ঐতিহাসিক ৬ দফায় যেন তার দল অটল থাকে এসব সাহসি সিদ্ধান্তের বেলাতেও বেগম মুজিব অটল ছিলেন। – বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এ সময় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের প্রশংসা করে বলেন, আওয়ামী লীগের কিন্তু একটা গুণ আছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। শুধু উপরে গেলে একটু উল্টা-পাল্টা হয়ে যায়।
তিনি বলেন, তখন আমি দেখেছি আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতারা ৮ দফা নিয়ে মেতে ওঠেন। কিন্তু আমার মা বলেন, উনি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়ে গেছেন, এর বাইরে এক পাও যাওয়া যাবে না।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মা’র কথা বলে শেষ করা যাবে না। দেশের জন্য তিনি কত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
আগষ্টের শেষ দিনে জাতির পিতার ৪২তম শাহাদৎবার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে ছাত্রলীগ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সংগঠনটির বার্ষিক প্রকাশনা ‘জন্মভূমি’র মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন।