• বৃহস্পতিবার , ১৬ মে ২০২৪

নারীদের ওপর জঘন্য নৃশংসতা চালিয়েছে হলি আর্টিসানে জঙ্গিরা


প্রকাশিত: ৫:৩০ পিএম, ১৪ জুলাই ১৬ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৪৫ বার

এস রহমান  :   হলি আর্টিসানে জঙ্গিরা নারীদের ওপরই বেশি নৃশংসতা চালিয়েছে। গুলশান হামলার Holy artisan women-www.jatirkhantha.com.bdপর লাশের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, হলি আর্টিসান বেকারিতে সবচেয়ে নিষ্ঠুরভাবে নারীদেরই হত্যা করেছে জঙ্গিরা। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যখম করা হয়েছে তাদের।

উনিশ বছরের তরুণী তারুশি জৈন। গুলশানে হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত ১৭ বিদেশি নাগরিকের মধ্যে ছিলেন উচ্ছল এই ভারতীয় তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসেন তারুশি। তার বাবা সঞ্জীব জৈন দেড় যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে পোশাক ব্যবসায় জড়িত। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকায় বসবাস করেন। ছুটিতে ঢাকায় বেড়াতে এসে জীবন থেকেই শেষ ছুটি নিলেন তারুশি। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতকে পড়ছিলেন তিনি। তারুশিদের মূল ভিটেবাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশের ফিরোজাবাদে।

তার শরীরজুড়ে ৪০টির মত আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাথার একপাশে কোপানো হয়েছে। দু’হাতেও রয়েছে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। পেটে-বুকেও কোপানো হয়। আঘাতের সংখ্যা ও ধরন বলছিল, কতটা ক্ষিপ্ত ও বর্বর ছিল হামলাকারীরা।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক প্যানেলের প্রধান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, শুধু তারুশি নন, গুলশানের ঘটনায় নিহত নারীদের  ওপরই সবচেয়ে বেশি বর্বর হামলা চালায় জঙ্গিরা। আলামত দেখে মনে হয়েছে, কোনো কারণে নারীদের ওপর বেশি ক্ষুব্ধ ছিল তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনাগত সন্তানের কথা বলে প্রাণভিক্ষা চেয়েও ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ইতালির এক নারী জঙ্গিদের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাননি।

নিহত আরও দুই বাংলাদেশি নারী ইশরাত আখন্দ ও অবিন্তা কবিরের শরীরে কোপানোর একাধিক চিহ্ন ও মাথায় জখম ছিল। এছাড়াও বাংলাদেশি নাগরিক ফারাজ হোসেনের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তার হাতে ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
নিহত ছয় জঙ্গির সবার শরীরে ছিল গুলির চিহ্ন। তাদের মধ্যে তিনজনের শরীরে আবার বোমার স্পিন্টার পাওয়া গেছে। এক জঙ্গির গুলি শরীর ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে যায়।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, যে বর্বর কায়দায় পাঁচ জঙ্গি ২০ জনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে, তা বর্ণনাতীত। প্রতিদিনই খুনোখুনির ঘটনা-সংক্রান্ত অনেক মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করছেন তারা। তবে এমন নিষ্ঠুর হামলার চিহ্ন তারা কখনোই দেখেননি। চিকিৎসকদের ধারণা, জড়িত জঙ্গিরা বাড়তি ’এনার্জিদায়ক’ কোনো ওষুধ সেবন করতে পারে।

এতে তারা আরও অমানবিক হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র পাঁচ তরুণ ২০ জনকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। জঙ্গিদের শরীরে ’ক্যাপটাগন’ জাতিয় কোনো ওষুধের অস্তিত্ব ছিল কি-না, তা পরীক্ষার জন্য তিন ধরনের আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছে। ওই নমুনার ভিসেরা পরীক্ষা করা হবে। ভিসেরার প্রতিবেদন পাওয়া গেলেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলায় নিজ কক্ষে বসে ডা. সোহেল মাহমুদ যখন ময়নাতদন্তের ব্যাপারে বিস্তারিত বলছিলেন। নিহত ১৭ বিদেশি নাগরিকের মধ্যে সাতজনের শরীর থেকে আটটি বুলেট চিকিৎসকরা উদ্ধার করেন। তার মধ্যে একজনের শরীরে দুটি বুলেট ছিল।

কারও শরীর ভেদ করে বুলেট বেরিয়ে গেছে। একজন জাপানি নাগরিকের মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়। সাত বিদেশি নাগরিককে পেছন দিক থেকে মাথায় গুলি করা হয়। এক বিদেশি বাদে সবার শরীরে কুপিয়ে আহত করার চিহ্ন রয়েছে। অনেকের একই জায়গায় বারবার কোপানো হয়েছে। এক বিদেশি নাগরিকের গলা, ঘাড়, থুতনি ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল।

গুলশানে জঙ্গি হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে ডিবির সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন খান নিহত হন। রবিউলের বুকের ডান পাশে স্পিন্টার ঢুকে গেছে। আর সালাহউদ্দিনের গলায় স্পিন্টার ঢুকেছিল। দু’জন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন বলে জানান চিকিৎসকরা।
ময়নাতদন্তের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরা বলছেন, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসানে রাত ১২টার মধ্যে ২০ জনকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। আর ছয় জঙ্গি মারা যায় তার সাত-আট ঘণ্টা পর।

গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নিহত সবার মরদেহ রাখা হয়েছিল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। এর পর প্রথমে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করতে ডা. সোহেল মাহমুদকে প্রধান করে চার সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়।

এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাথমিক আলামত দেখে তাদের ধারণা, হলি আর্টিসানে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হননি। আরও নিশ্চিত হতে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য নমুনা মহাখালীর রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে।

দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গুলশানে রেস্টুরেন্টে হামলার সময় ইতালির নাগরিক মারিয়া রোবিলি (৩৫) বারবার অনাগত সন্তানের কথা জানিয়ে প্রাণভিক্ষা চান। তবে জঙ্গিদের চরম নিষ্ঠুর মন এতটুকু টলেনি।
কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত ডিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনে নিহতদের কিছু আলামত পরীক্ষা করতে বিদেশে পাঠানো হবে।

সুরতহাল প্রতিবেদন: লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, নিহতদের শরীরজুড়ে ছিল ভয়াবহতার সব চিহ্ন। মরদেহের পরনে জামাকাপড় ছিল রক্তেভেজা। মাথায় আঘাতে অনেকের মগজ বেরিয়ে যায়। আবার কারও রক্তভেজা মুখ দেখে লাশ শনাক্ত করাও ছিল যেন কষ্টসাধ্য। চাপাতির আঘাতে কারও কানও কেটে গেছে।

গত ১ জুলাই হোটেল আর্টিসানে হামলায় মোট ২৮ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ১৭ বিদেশি নাগরিক, তিন বাংলাদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১০ জন নারী। এ ছাড়া কমান্ডো হামলায় ছয় জঙ্গি নিহত হয়। জঙ্গিদের ছাড়া সবার লাশ নিয়ে গেছে পরিবার।