নারায়নগঞ্জে ৭ খুন: লেডিকিলার মেজর আরিফের মাসোহারা ছিল ১০ লাখ টাকা
নারায়নগঞ্জ .থেকে দেব দুলাল:সাত খুনের মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে র্যাব-১১-এর নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক অধিনায়ক লেডিকিলার মেজর আরিফের মাসোহারা ছিল ১০ লাখ টাকা।এই টাকায় আরিফ তার অপরাধ সাম্রাজ্যে ফূর্তি করে উড়াতো। বিনিময়ে নূর হোসেন পেতেন চাহিদামাফিক অবৈধ সুযোগ-সুবিধা।মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাতজন অপহরণ হওয়ার আগে ২১ দিনে মেজর আরিফের সঙ্গে টেলিফোনে ২৭ বার কথা বলেছিলেন নূর হোসেন।
১১ মাস তদন্ত শেষে গত ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল এ ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার অভিযোগপত্র নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম চাঁদনি রূপমের আদালতে দাখিল করেন। তবে নিহত নজরুলের স্ত্রী এতে নারাজি দেন। আগামী ৮ জুন পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এর আগে মেজর আরিফ আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান তাঁকে বলেছিলেন ‘আজকের মধ্যে নূর হোসেনকে মেরে ফেলতে হবে।’ তবে অভিযোগপত্রে এ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মণ্ডল বলেন, ‘সে আদেশ তো কার্যকরই হয়নি। তা ছাড়া আমরা তদন্তে যা পেয়েছি, তা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছি।’
সাত খুনের অভিযোগপত্রে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ মোট ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই ৩৫ আসামির ২২ জন কারাগারে আছেন। বাকি ১৩ জন পলাতক আছেন, যাঁদের মধ্যে র্যাব সদস্যই আটজন।
অভিযোগপত্রের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, এই মামলার তদন্তের একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের ৪০ দিন পর নিহত সাতজনের লাশ কবর থেকে তুলে পুনঃ ময়নাতদন্ত করতে চেয়েছিল পুলিশ। তাদের প্রত্যাশা ছিল, এতে বিষাক্ত ইনজেকশনের বিষয়টি পরীক্ষায় ধরা পড়বে। কিন্তু এ ধরনের ইনজেকশনের বিষক্রিয়া দীর্ঘ থাকে না বলে জেলা সিভিল সার্জনের মতামত পাওয়ার পর সে পরিকল্পনা বাতিল করে তারা।
অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হয়ে নূর হোসেন অবৈধভাবে জমি দখল, শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, কাঁচপুর সেতুর নিচে পাথর-বালুর ব্যবসা, মদের আড়ত, যাত্রার নামে হাউজি, জুয়া খেলা, প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করে প্রতিদিন প্রায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা আয় করতেন। মেজর আরিফ হোসেন আদমজী ক্যাম্পের কমান্ডারের দায়িত্ব নেওয়ায় নূর হোসেনের অফিসে প্রতি মাসে ৮-১০ বার যেতেন। ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনার জন্য তিনি (আরিফ) নূর হোসেনের কাছ থেকে টাকাও নিয়েছেন। এই সুযোগে নূর হোসেন তাঁর প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দিতে আরিফের সাহায্য নেন। তাঁদের পরিকল্পনা অনুসারে নজরুল ইসলাম ও তাঁদের সঙ্গে থাকা লোকজনকে অপহরণ করা হয়। নজরুলসহ পাঁচজনকে অপহরণ করার দৃশ্য পেছন থেকে আসা ছাই রঙের প্রাইভেট আরোহী চন্দন সরকার দেখে ফেলে চিৎকার শুরু করলে লে. কমান্ডার রানা টানাহেঁচড়া করে তাঁকে ও তাঁর চালক ইব্রাহীমকে তাঁর মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেন। এরপর লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদের নির্দেশমতো ঘটনাস্থলে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকারের প্রাইভেট কারটি চালক মিজানকে সঙ্গে নিয়ে লে. কমান্ডার এম এম রানা ঢাকার গুলশানের নিকেতনে ফেলে রেখে আলামত গোপনের চেষ্টা করেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১ নম্বর আসামি নূর হোসেন পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পরের যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে র্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যদের ব্যবহার করে তাঁর প্রতিপক্ষ নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করেন। এরপর কাঁচপুর বিআইডব্লিউটিএর ল্যান্ডিং ঘাটের আশপাশে নিজস্ব পাহারা দিয়ে সাতজনকে হত্যার পর লাশ গুম করেন।
লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ এলিট ফোর্সের অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে অনৈতিকভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার জন্য অন্যের প্ররোচনায় অধীনস্থ কর্মকর্তা ও সদস্যদের দ্বারা অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুমের নির্দেশ দেন।
মেজর আরিফ হোসেন এলিট ফোর্সের ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে পূর্বপরিকল্পিতভাবে অন্যের প্ররোচনায় অনৈতিকভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে নিজে উপস্থিত থেকে নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণ, হত্যা, লাশ গুম করেন। আবার সঙ্গে থাকা অন্য র্যাব সদস্যদের একই অপরাধ করার আদেশ দেন।
লে. কমান্ডার এম এম রানা এলিট ফোর্সের ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব থেকে র্যাব-১১ অধিনায়কের নির্দেশে মেজর আরিফ হোসেনকে তাঁর কোম্পানির সদস্যদের দিয়ে ও নিজে উপস্থিত থেকে সাতজনকে অপহরণের কাজে সহায়তা, নিহত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত দুটি প্রাইভেট কার লোকচক্ষুর আড়াল এবং হত্যা ও লাশ গুমের কাজে ক্যাম্প থেকে ট্রলার দিয়ে সহায়তা করেন।
এসআই পূর্ণেন্দু বালা, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, হিরা দিয়া, সৈনিক আল আমিন শরিফ, আবদুল আলিম, মহিউদ্দিন মুন্সী, কনস্টেবল শিহাবউদ্দিন, সিপাহি আবু তৈয়ব, মেজর আরিফের নির্দেশে সাতজনকে অপহরণ, হত্যা, লাশ গুম করেন।
সার্জেন্ট এনামুল কবির, হাবিলদার এমদাদুল হক, নাছিরউদ্দিন, এএসআই বজলুর রহমান, সৈনিক তাজুল ইসলাম মেজর আরিফের নির্দেশে প্লাস্টিকের বস্তায় ইট ভর্তি করে প্যাকেট তৈরি করে সাতজনকে হত্যা ও লাশ গুমে সাহায্য করেন।
সৈনিক মো. আসাদুজ্জামান নুর মেজর আরিফের হুকুমে র্যাব ক্যাম্প থেকে মোটরসাইকেলযোগে পলিথিন মেজর আরিফের কাছে পৌঁছে দিয়ে হত্যা ও লাশ গুমে সহায়তা করেন। করপোরাল মোখলেছুর রহমান, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন, বাবুল হাসান, সৈনিক নুরুজ্জামান, হাবিবুর রহমান, মেজর আরিফ ও লে. কমান্ডার রানার নির্দেশে সাতজনকে অপহরণ, বিআইডব্লিউটিএর ল্যান্ডিং ঘাটে পাহারা দিয়ে হত্যা কাজে সহায়তা করেন।
নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আসামি শাহাজাহান, মুর্তজা জামান, আলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আবুল বাশার, সেলিম ছানাউল্লাহ, জামালউদ্দিন, রিয়াজ, কাঁচপুর বিআইডব্লিউটিএ ল্যান্ডিং ঘাটে ও তার আশপাশে নূর হোসেনের নির্দেশে পাহারা দেন, যাতে মেজর আরিফ ও র্যাবের লোকজন নির্বিঘ্নে সাতজনকে হত্যা ও লাশ গুম করতে পারেন। তবে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পাওয়ায় আসামি রিয়াজকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।