• বুধবার , ২৭ নভেম্বর ২০২৪

নানা আঙ্গিকে সারা দেশে বর্ষবরণ ১৪৩০


প্রকাশিত: ৭:৪৯ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২৩ , শুক্রবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭৪ বার

বিশেষ প্রতিনিধি : ব্যাপক নিরাপত্তায় শুক্রবার নানা আয়োজনে, নানা আঙ্গিকে সারা দেশে চলছে বর্ষবরণ এবং নানা উৎসব। ছায়ানট রাজধানীর রমনা বটমূলে ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে বরণ করেছে নব আলোর আহ্বানে।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে আহির ভৈরব সুরে সারেঙ্গিবাদনের মধ্যে দিয়ে রমনা বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্টান। নাগমায় শিল্পী শৌণক দেবনাথ ঋকের সঙ্গে তবলায় সংগত করেন শিল্পী গৌতম সরকার। ১০টি সম্মেলক গান, ১১টি একক গান, দুটি আবৃত্তি এবং সবশেষে জাতীয় সংগীতে সাজানো হয় এ অনুষ্ঠানমালা।

বৈশাখী কথন পর্বে ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, “নববর্ষের সূর্যদয়ের নবীনকিরণ যখন আমাদের আলোকিত করে, তখন ফিরে দেখি ফেলে আসা দিনগুলো। ধারাবাহিক অগ্রগতি দেশের ভবিষ্যতের পদরেখা হিসেবে আমাদের প্রাণে আশার সঞ্চার করে। অন্যদিকে লোভ, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও বৈষম্য আমাদের হতাশ করে সমাজে বিভাজন রেখাবে গভীর ও বিস্তীর্ণ করে আমাদের অর্জনগুলো ম্লান করে দেয়।

আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার সাহিত্য ও সংগীত সমাজের শুভশক্তিকে জাগ্রত করে সম্প্রীতির বন্ধনকে নিবিড়তর করে চলেছে। সারা দেশ জুড়ে এই ধারার গান ও পাঠ সমাজের বিভক্তি অতিক্রম করুক, অশুভ প্রবণতার বিনাশ ঘটাক, নূতন বছরের অগ্রসর চিন্তার ভিত্তি নির্মাণ করুক।

বক্তব্যের শেষে তিনি অভ্যাগত সব সংস্কৃতিমনা মানুষদের উদ্দেশে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন প্রত্যয়ধ্বনি, শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান। সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান।নতুন বঙ্গাব্দে সর্বজনের জীবনে মঙ্গল প্রার্থনায় কথন শেষ করেন লাইসা আহমদ লিসা।প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী চলে ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজন। যন্ত্রসংগীতে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে সম্মেলক কণ্ঠে ধ্বনিত হয় রবীন্দ্রসংগীত ‘ধ্বনিল মধুর গম্ভীর’। পরে সেঁজুতি বড়ুয়া শোনান রবীন্দ্রসংগীত ‘মনমোহন।

সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ আবৃত্তি করেন ‘বৈশাখ’। পরে একক কণ্ঠে ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে’ শোনান পার্থ প্রতীম রায়, ‘মোরে ডাকি লয়ে যাও’ শোনান মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য। বড়দের দল গেয়ে শোনায় সম্মেলক গান ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির-নির্মল’। পরে রেজাউল করিমের কণ্ঠে গীত হয় ‘ওগো অন্তর্যামী ভক্তের তব’। এরপর ছোটেদের দল সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ‘মৃদুল মন্দে মঞ্জুল ছন্দে’।এছাড়া একক কণ্ঠে ‘অন্তরে তুমি আছ চিরদিন’ শোনান খায়রুল আনাম শাকিল; ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’ শোনান ইফ্‌ফাত আরা দেওয়ান; ‘স্বদেশ আমার! জানি না তোমার’ শোনান মইদুল ইসলাম; ‘নিচুর কাছে নিচু হতে’ শোনান ফারহানা আক্তার শ্যার্লি; ‘সবারে বাস রে ভালো’ শোনান লাইসা আহমদ লিসা; ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’ শোনান আবুল কালাম আজাদ; ‘মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই’ শোনান মো. খায়রুল ইসলাম; ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে’ শোনান চন্দনা মজুমদার।

সম্মেলক কণ্ঠে ছোটদের দল শোনায় ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান’, ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না’, ‘এই আমাদের বাংলাদেশ’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’। বড়দের দল গেয়ে শোনায় ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব’, ‘আমাদের নানান মতে’। মাহমুদা আখতার আবৃত্তি করেন ‘দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জীর।

অনুষ্ঠানের শেষ ভাগে যখন ছোট আর বড়দের দল মিলে সম্মেলক কণ্ঠে গাইছিল শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’ গানটি, ততক্ষণে ভোরের স্নিগ্ধ আলো পরিণত হয়েছে গ্রীষ্মের ঝলসানো রোদে। তবুও হাজারো মানুষ সমস্বরে কণ্ঠ মিলিয়ে একসঙ্গে গেয়ে যান ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।ছায়ানট সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতাদের সম্মেলক কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজন।

অনুষ্ঠানে যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন তবলায় এনামুল হক ওমর, গৌতম সরকার, স্বরূপ হোসেন। ঢোলে শিবু দাস, মন্দিরায় প্রদীপ কুমার রায়, সেতারে ফিরোজ খান, এস্রাজে অসিত বিশ্বাস, বাঁশিতে মো. মামুন, কিবোর্ডে রবিন্স চৌধুরী এবং দোতারায় অরূপ কুমার শীল সঙ্গত করেন। রমনা উদ্যানের এ আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। দেখা গেছে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও।

করোনাভাইরাস মহামারীর খাঁড়া কাটিয়ে এবার বিধি-নিষেধের বেড়াজাল ছাড়াই নতুন বছর বরণ করছে বাঙালি। সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আয়োজনে তপ্ত এই বৈশাখ হয়ে উঠেছে বর্ণিল উৎসব।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে নতুন বাংলা বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দুজনের শুভেচ্ছা বাণীতেই প্রত্যাশা সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগোনোর।পঞ্জিকার পাতা উল্টে ১৪২৯ থেকে ১৪৩০ সাল আসা সাধারণ একটি ঘটনা হলেও বাঙালির জীবনে এই সাধারণ ঘটনার শুরুই হয় ভিন্ন মাত্রা নিয়ে।

কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয় হিসেবে বৈশাখকে সামনে এনে বাংলা সাল প্রবর্তনের পর বাঙলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন প্রভাবিত করলেও তা রাজনৈতিক হয়ে ওঠে পাকিস্তান শাসনামলে।

পাকিস্তানের সেনাশাসক আইয়ুব খানের আমলে যখন বাঙালির বাঙালিয়ানা নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়, তখন এই বর্ষবরণ উৎসব হয়ে উঠেছিল বাঙালির আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক হাতিয়ার। এই চেতনাই পরে বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতার বন্দরে পৌঁছে দেয়।

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশকে পরেও নানা সংকটে দিশা দেখিয়েছে পহেলা বৈশাখের উৎসব; সেই কারণেই এই দেশকে উল্টো পথে নেওয়ার চেষ্টায় বার বার আঘাত এসেছে এই উৎসবে।

তার ধারাবাহিকতায় এবারও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দিয়ে চিরকুট এসেছে, যদিও তা আমলে নেওয়ার মতো নয় বলে আশ্বস্ত করেছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

পাকিস্তান আমলে ছায়ানট সংস্কৃতি কেন্দ্র রমনার বটমূলে প্রতিবাদী উচ্চারণে বৈশাখ বরণের যে আয়োজন করেছিল, তা কালে হয়ে উঠেছে নগরে এই উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ। তার সঙ্গে পরে যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা।

এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’। তার কারণ ব্যাখ্যা করে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “বর্তমানে মানুষের মাঝে হানাহানি, অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তার চরম মাত্রায় পৌঁছে এই রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও চরম ধ্বস নেমেছে। তাই আমাদের এবারের কামনা পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক।।”

গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল; সেটিই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এ কর্মসূচি।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবারও কোনো মুখোশ মুখে পরা যাবে না, নেওয়া যাবে না ব্যাগ। তবে চারুকলা অনুষদের বানানো মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা বিধি-নিষেধের বাইরে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা নিষেধ।

ক্যাম্পাসে সব ধরনের অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে। ক্যাম্পাসে বিকাল ৫টার পর কোনোভাবেই ঢোকা যাবে না; শুধু বের হওয়া যাবে।

নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের যানবাহন চালানো যাবে না এবং মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণ নিষেধ।