• শনিবার , ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ধুরন্ধর যুবলীগারের তেলসমাতি


প্রকাশিত: ১১:৫৩ পিএম, ১২ মে ২৪ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৮ বার


২৪ ঘন্টার মধ্যে আত্মসমর্পনের নির্দেশ হাইকোর্টের-

কোর্ট রিপোর্টার : মাদক মামলায় অর্থের বিনিময়ে অন্য আসামির জেল খাটার ঘটনায় যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। রোববার (১২ মে) বিচারপতি আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চ এ আদেশ দেন। প্রতারণার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানান, নাজমুলকে এখন যেকোনো আইনি কার্যক্রম চালাতে হলে আত্মসমর্পণ করেই করতে হবে। মঙ্গলবার এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
এর আগে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিচারক, আইনজীবী ও কারা কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা তলব করে হাইকোর্ট জানতে চান, কীভাব একজনের পরিবর্তে অন্য আসামি জেলে ঢুকলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের আগস্টে উত্তরার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ একজনকে আটক করা হয়। তবে পালিয়ে যান চক্রের মূলহোতা যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসান। এ ঘটনায় দুজনকে আসামি করে মামলা করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিচারে পলাতক নাজমুল হাসানকে সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। পরে জানা যায়, এ পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে যিনি জেল খেটেছেন, তার প্রকৃত নাম মিরাজুল ইসলাম।

নাজমুলের অপরাধ মিশন-

স্থানীয়রা বলছেন, শুধু কাঁচাবাজার নয়, তুরাগের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাঁদাবাজি চলে নাজমুলবাহিনীর নামে। এর মধ্যে কামারপাড়া, নলভোগ, পুরান কালিয়া, রানাভোলা, ধউর ও ১১ নম্বর সেক্টরে নাজমুলের অস্ত্রধারী বাহিনীর তৎপরতা ব্যাপক। ধউর বেড়িবাঁধ এলাকায় অবৈধ বালুর গদি, বিআইডব্লিউটিএ-এর ল্যান্ডিং স্টেশন এবং দিয়াবাড়ী মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রতিমাসে এভাবে আদায়কৃত চাঁদার অঙ্ক বিশাল।

জানা যায়, উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে রাজউকের একাধিক প্লট দীর্ঘদিন ধরে নাজমুলের দখলে। বর্তমানে সেখানে অবৈধ ফার্নিচার মার্কেট তৈরি করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তুরাগের সাউদার্ন ও আইএফএল নামের দুটি বৃহৎ গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান নাজমুলবাহিনীর হাতে রীতিমতো জিম্মি। গার্মেন্টের জুট থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বিনাবাক্যে তুলে দিতে হয় নাজমুলবাহিনীর হাতে।

স্থানীয়রা বলছেন, এসব জমির বেশির ভাগই দখল অথবা অস্ত্রের মুখে লিখে নেওয়া। শুধু তুরাগ নয়, আশুলিয়া ও গাজীপুর এলাকার বহু জমিতে এমন সাইনবোর্ড ভূরিভূরি। এছাড়া তার পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে-বেনামে দখল হয়েছে আশপাশের বিপুল ভূসম্পত্তি। এর মধ্যে কবরস্থান রোডে ভাই ভাই মার্কেট, রানাভোলা রোডে তাসলিমা মার্কেট, তাসলিমা প্লাজাসহ আশপাশের কয়েকশ বিঘা সম্পত্তি নাকি নাজমুলের পৈতৃক সম্পত্তি। এছাড়া ধউর এলাকার ইস্টওয়েস্ট মেডিকেল সংলগ্ন শতকোটি টাকা মূল্যের বিশাল জায়গা এবং উত্তরণ আবাসিক এলাকার পেছনে বিশাল জলাশয়ও নাকি কিনেছেন তার বাবা হাসিম চেয়ারম্যান। তবে এলাকাবাসী বলছেন, দখল জমির অনেকাংশ ভাওয়াল এস্টেটের আওতাভুক্ত। এছাড়া হতদরিদ্র অনেকের জমি লিখে নেওয়া হয় অস্ত্রের মুখে।

এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, তুরাগের রোসাদিয়া ঘাট ও তালতলা গুদারাঘাট চলে নাজমুলের চাচাতো ভাই আরিফ হাসানের নামে। এ সুযোগে ঘাট ও আশপাশের এলাকায় সারি সারি টিনের ঘর, টং দোকান ও অবৈধ বাস-ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া নাগেরটেক এলাকায় অবৈধ ব্যাটারি কারখানা গড়ে তুলেছেন নাজমুল। সেখানে পুরোনো ব্যাটারি ভাঙায় ক্ষতিকর পারদ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের জলাশয়ে। এ নিয়ে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এছাড়া খায়েরেরটেক এলাকায় সরকারি জমিতে শতাধিক বস্তিঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন নাজমুলের লোকজন।

সম্প্রতি এক মাদক মামলায় নাজমুলকে ৭ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। কিন্তু সাজা থেকে বাঁচতে অভিনব কৌশল নেন তিনি। আলোচিত আয়নাবাজি সিনেমার মতোই নাজমুল সাজিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় ডামি আসামি। এ সময় মোটা অঙ্কের অর্থের প্রলোভনে নাজমুলের হয়ে জেল খাটেন মিরাজুল নামের হতদরিদ্র এক যুবক। ১১ দিন জেল খেটে ২০ আগস্ট জামিনে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হন মিরাজুল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী টাকা না পেলে ঘটনা ফাঁস করে দেন তিনি। এ ঘটনায় এখন এলাকায় তোলপাড় চলছে।

নাজমুলের বদলে চুক্তিতে কারাভোগ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিরাজুল বলেন, ‘সে (নাজমুল) বলছিল আমাকে বাড়িগাড়ি কইরা দিব। আমার লাইফ সেট কইরা দিব। বিনিময়ে তার জন্য আমাকে জেল খাটতে হবে। কিন্তু অহন এর কিছুই দেয় না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিরাজুল বলেন, ‘আমি দিন আনি দিন খাই। চুক্তি অনুযায়ী যা দেওয়ার কথা ছিল তা না দিয়া আমাকে এক লাখ টাকা ধরাইয়া দিছে।’

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রেকর্ডে নাজমুলের আয়ানাবাজির অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। জেলখানার রেকর্ডবুকে আসামি হিসাবে নাজমুলের নাম ও পিতার নাম ঠিক থাকলেও ছবি রয়েছে মিরাজুলের। এছাড়া কারাগারের প্রিজনার্স (বন্দি) তথ্যভান্ডারেও রয়েছে ভিন্ন ফিঙ্গারপ্রিন্ট।

সূত্র জানায়, তুরাগে নাজমুলের একচ্ছত্র দাপটের পেছনে জনৈক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার হাত রয়েছে। অজ্ঞাত কারণে তিনি তুরাগ এলাকায় বিপুল পরিমাণ জমি কিনেছেন। লাঠিয়াল হিসাবে এসব জমি দেখভাল করে নাজমুলের লোকজন। এজন্য দলীয় পদ পাইয়ে দিতে নাজমুলের পক্ষে তদবির করেন ওই প্রভাবশালী নেতা।

এছাড়া এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন নাজমুল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নাজমুলের হয়ে বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করেন। তাদের মধ্যে আছেন রানাভোলার কাশেম, আমির আলীর ছেলে খোরশেদ আলম ওরফে রানা, আবুল ফজলের ছেলে আলামিন, গুলগুল্লা মোড়ের নাসির, কুদ্দুস মিয়ার ছেলে ফরিদ ও ফরহাদ, ধউরের হাবিব, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা এসএম শাহদাৎ হোসেন ওরফে সেতু, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের কথিত নেতা নজরুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, স্থানীয় মিন্নত আলীর ছেলে সাদ্দাম, শিপলু, কেরামত আলীর ছেলে রাতুল ও আক্কাস আলীর ছেলে সজীব।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে ২৫ নম্বর রোডে নাজমুলের বাড়িতে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ম্যাসেজ পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।তুরাগ থানা যুবলীগের নেতারা জানান, দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে নাজমুলকে দেখা গেলেও তার কোনো পদ-পদবি নেই। তবে তিনি পদ পাওয়ার চেষ্টা করছেন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছেন।

কথিত যুবলীগ নেতা নাজমুলের বিরুদ্ধে দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী যুবলীগের (উত্তর) সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন বলেন, গণমাধ্যমে এ সম্পর্কে বেশকিছু অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হবে। বাস্তবে তিনি যদি চাঁদাবাজি বা দখলের মতো অপরাধে জড়িত হন তবে তাকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে অভিযোগ তদন্ত করে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।