• শুক্রবার , ১৮ অক্টোবর ২০২৪

ধর্ষণ করে হত্যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড-এ বিধানটি অসাংবিধানিক-আপিল বিভাগ


প্রকাশিত: ৪:১৯ এএম, ৬ মে ১৫ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৮ বার

rape-www.jatirkhantha.com.bdবিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা: সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মঙ্গলবার এক রায়ে বলেছেন, ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের তিনটি ধারা অসাংবিধানিক। এর মধ্যে দুটি ধারায় ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া বিকল্প সাজার বিধান নেই। একই সঙ্গে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩৪ (২) ধারাও অসাংবিধানিক ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। আপিল বিভাগের এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ১৯৯৫ সালে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬ (২), ৬ (৩) ও ৬ (৪) ধারা অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। ৬ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ধর্ষণ করেন বা ধর্ষণের পর কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটান, তাহলে ওই ব্যক্তির সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। ৬ (৪) ধারা অনুসারে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করেন বা ধর্ষণের পর কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটান, তাহলে ওই ব্যক্তির সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড।

আর ৬ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, যখন একাধিক ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তখন ওই ব্যক্তিদের প্রত্যেকের সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ৬ (২) ও ৬ (৪) ধারায় মৃত্যুদণ্ড ছাড়া বিকল্প সাজার বিধান নেই। অর্থাৎ এই দুটি ধারায় মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো সাজা দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের সামনে রাখা হয়নি। এ জন্য সর্বোচ্চ আদালত এই ধারাগুলোকে সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন।
১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল।

পরে ২০০০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নামে নতুন আরেকটি আইন করা হয়। নতুন আইনের ৩৪ (১) ধারায় পুরোনো আইনটি রহিত করা হলেও ৩৪ (২) ধারায় বলা হয়, পুরোনো আইনটি রহিত করার আগ পর্যন্ত ওই আইনের অধীনে যেসব মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে, সেগুলো পুরোনো আইনের অধীনেই পরিচালিত হবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, নতুন আইনের ৩৪ (২) ধারাটিও আপিল বিভাগ সংবিধান পরিপন্থী বলে রায় দিয়েছেন।

তাহলে ১৯৯৫ সালের আইনের অধীনে অনিষ্পন্ন মামলাগুলো কোন আইন অনুসারে চলবে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হলে এটা বলা যাবে না। তবে আমার মনে হয়, যেহেতু ২০০০ সালের আইনে ধর্ষণের সাজায় মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অর্থদণ্ডসহ নানা ধরনের সাজার বিধান রয়েছে, তাই পুরোনো আইনের অধীনে অনিষ্পন্ন মামলাগুলো নতুন আইনে চলতে পারে। তবে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রায়ই এ নিয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে পারবে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ১৯৯৫ সালের আইনের ১০ ধারায় (এটি ২০০০ সালের আইনের ১১ ধারায় রয়েছে) বলা হয়েছে, যদি কোনো নারীর স্বামী বা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন; তাহলে উক্ত স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ বিষয়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়ে বলেছেন, এ ধারাটিকেও সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ধর্ষণের পর হত্যার একটি মামলাকে কেন্দ্র করে। মামলার নথি অনুসারে, ১৯৯৬ সালের ১১ জুন শিবালয় থানার শিবরামপুর গ্রামের শুকুর আলী নামের ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। ২০০১ সালের ১২ জুলাই মানিকগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল শুকুর আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০০৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এবং ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ শুকুর আলীর মৃত্যুদণ্ডের ওই রায় বহাল রাখেন।

এরপর ২০০৫ সালের ২৩ নভেম্বর মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। শুকুর আলী ওই আবেদনের একটি পক্ষ ছিল। ওই রিট আবেদনে ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৬ (২) ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে শুকুর আলীর দণ্ডাদেশকে অবৈধ চাওয়া হয়।

২০১০ সালের ২ মার্চ হাইকোর্ট ৬ (২) ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করলেও শুকুর আলীর দণ্ডাদেশের বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। এরপর শুকুর আলীর দণ্ডাদেশকে অবৈধ চেয়ে ব্লাস্ট আপিল করে। গতকাল ওই আপিল মঞ্জুর করে ১৯৯৫ সালের আইনের তিনটি ধারা সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হয়।

ব্লাস্টের আইনজীবী নাজনীন নাহার বলেন, ‘যেহেতু আপিল বিভাগ আমাদের আপিল মঞ্জুর করেছেন, সেহেতু শুকুর আলীর দণ্ডাদেশ অবৈধ হয়ে গেল।’ তবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলছেন, শুকুর আলীর সাজা মওকুফ হবে কি হবে না, তা পূর্ণাঙ্গ রায় বের না হওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আপিল বিভাগের এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে ব্লাস্ট। শুকুর আলীর রিট মামলা পরিচালনাকারী জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী বলেছেন, এই রায়ের মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুর, অবমাননাকর ও অমানবিক সাজার বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি একধাপ এগোল।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্লাস্টের সাবেক আইন উপদেষ্টা শাহদীন মালিক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন ফৌজদারি আইনে অত্যন্ত কঠোর সাজার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অন্তত একটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত মানবিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।