• বুধবার , ৮ মে ২০২৪

দিনে ওকালতি রাতে ভয়ংকর জঙ্গী-জঙ্গী অর্থায়নের জবানবন্দী দিলেন শাকিলারা


প্রকাশিত: ২:৪৯ এএম, ২৪ আগস্ট ১৫ , সোমবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ২২১ বার

 

jongi advocate-www.jatirkhantha.com.bdবিশেষ প্রতিবেদক:  জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেফতার তিন আইনজীবী গতকাল রবিবার চট্টগ্রামের একটি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরা হলেন- জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, অ্যাডভোকেট হাসানুজ্জামান লিটন ও অ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন। বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাজ্জাদ হোসেনের খাস কামরায় গতকাল রবিবার বেলা ১০টা ৪০ থেকে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত ১৬৪ ধারায় তিন আইনজীবীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দির পর তিন আইনজীবীর জামিনের জন্য আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা। আদালত এ আবেদন নামঞ্জুর করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আসামিদের কারাগারে ডিভিশন দেয়ার আবেদন করলে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আদালত নিদের্শনা প্রদান করেন।

এদিকে তিন আইনজীবীকে হাটহাজারী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে দায়ের হওয়া একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করেছে র্যাব। এ বিষয়ে শুনানির জন্য আজ সোমবার তিন আইনজীবীকে হাটহাজারীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত করা হবে বলে র্যাব ৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ ইত্তেফাককে জানিয়েছেন। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর মাদ্রাসাতুল আবু বকর নামে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জঙ্গি সন্দেহে ১২ জন আটকসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সামগ্রী উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয় থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে এই মামলাটি দায়ের করা হয়।

লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ ইত্তেফাককে জানান, জবানবন্দিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ তিন আইনজীবী। মনিরুজ্জামান ডনসহ কয়েকজনের অ্যাকাউন্টে টাকা দেয়ার কথা তারা স্বীকার করেছেন। মনিরুজ্জামান ডন জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের অর্থায়নকারী। হাটহাজারীর আবু বকর মাদ্রাসা এবং বাঁশখালী জঙ্গি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ডন অর্থ দিয়েছেন। তবে শাকিলা আদালতকে জানিয়েছেন, তিনি ডনের পরিচয় জানেন না। তিনি হেফাজতে ইসলামের মামলা পরিচালনা করতেন। মামলা সংক্রান্ত কিছু টাকা তিনি ফেরত দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, শহীদ হামজা ব্রিগেডকে অর্থায়নের অভিযোগে গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানাসহ তিন আইনজীবীকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের বিরুদ্ধে শহীদ হামজা ব্রিগেডকে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। গ্রেফতার তিনজনকে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর লটমনি পাহাড় থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে তিন আইনজীবীকে গতকাল পুনরায় আদালতে উপস্থিত করা হলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এর আগে গতকাল সকাল ১০টার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-৭ এর এএসপি রহুল আমিন তাদেরকে আদালতে নিয়ে আসেন। আইনজীবী মো. হাসানুজ্জামান লিটন, মাহফুজ চৌধুরী বাপন এবং ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা একে একে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি গ্রহণ শেষ হয় দুপুর দেড়টার দিকে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন বলেন, র্যাবের মাধ্যমে আসামিদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং অন্য মামলায় গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। জবানবন্দি গ্রহণের কমপক্ষে তিন ঘন্টা পূর্বে আসামিকে ম্যাজিস্ট্রেটের হেফাজতে প্রদান করার নিয়ম রয়েছে যাতে তারা মানসিকভাবে আশ্বস্ত বোধ করতে পারেন। কিন্তু তিন আইনজীবীকে ম্যাজিস্ট্রেটের জিম্মায় না রেখে র্যাবের কাস্টডিতে রাখা হয়েছে। র্যাবের বেষ্টনিতে তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় প্রবেশ ও বের করা হয়েছে।

অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন অভিযোগ করেন, রিমান্ডে নিয়ে শাকিলাসহ তিন আইনজীবীকে নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করা হয়েছে। আসামিদের আইনজীবীদের সাথে কথা বলতে দেয়া হয়নি। ভয়ভীতি দেখানোর কারণে শাকিলাকে আদালত এলাকায় কান্না করতে দেখা গেছে।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন বলেন, জবানবন্দি নেয়ার বিষয়ে কোনো ধরনের নিয়মের ব্যত্যয় করা হয়নি। আসামিদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব র্যাবের। র্যাব সদস্যরা সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।

হাটহাজারী থানার মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন প্রসঙ্গে র্যাব অধিনায়ক বলেন, মনিরুজ্জামান ডন শহীদ হামজা ব্রিগেডের জন্য হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসাকে টাকা দিয়েছিল। সেই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ডে নেয়ার প্রয়োজন।

র্যাবের দাবি, জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা জমা করার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এর মধ্যে মনিরুজ্জামান ডনসহ কয়েকজনের অ্যাকাউন্টে নগদে এক কোটি আট লাখ টাকা জমা দিয়েছেন গ্রেফতার তিন আইনজীবী। এর মধ্যে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা দিয়েছেন দুই ধাপে ৫২ লক্ষ টাকা। হাসানুজ্জামান লিটন ৩১ লাখ টাকা এবং বাপন দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা।

শাকিলার অপর আইনজীবী জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রাম শাখার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন, মনিরুজ্জামান মাসুদ ওরফে ডন হেফাজতে ইসলামের মামলা পরিচালনার বিষয়ে আসামিপক্ষের হয়ে শাকিলা ফারজানার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। মামলা পরিচালনার জন্য তিনি শাকিলাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন। পরে শাকিলা আবার ওই টাকা ডনের অ্যাকাউন্টে ফেরত দিয়েছিলেন। ফেরত দেয়া টাকাগুলোকেই জঙ্গি অর্থায়ন হিসেবে ধরে নিয়েছে র্যাব।

প্রসঙ্গত, এ বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী এলাকায় আল মাদ্রাসাতুল আবু বকর নামে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে আটক করে র্যাব। পরে তাদেরকে জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের সদস্য হিসেবে শনাক্ত করে হাটহাজারী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়। মাদ্রাসাটিকে হামজা ব্রিগেডের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে দাবি করে র্যাব। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর লটমনি পাহাড় থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ সরঞ্জামসহ ৫ জনকে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর হালিশহর থানার একটি আবাসিক এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব।

গত ১২ এপ্রিল রাতে নগরীর কোতোয়ালি থানার মিডটাউন আবাসিক হোটেলে অস্ত্র কেনাবেচার সময় বিক্রেতা মোজাহের হোসেন মিয়া এবং বাঁশখালীতে জঙ্গি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাব্বির আহমেদ ওরফে মুহিবকে গ্রেফতার করে র্যাব। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন রাতে আকবর শাহ থানার একে খান মোড়ে একটি বাস কাউন্টার থেকে মো. কামাল উদ্দিন ওরফে মোস্তফা এবং আশরাফ আলীম ওরফে আদনানকে আটক করা হয়।

গত ৭ মাসে কথিত জঙ্গি সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেডের বিরুদ্ধে ৮টি অভিযান পরিচালনা করে ৩২ জনকে গ্রেফতার ছাড়াও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র, বিস্ফোরক, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও সামরিক প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম উদ্ধার করে র্যাব। গ্রেফতার ৩২ জনের মধ্যে ৩১ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। হামজা ব্রিগেডের বিরুদ্ধে অভিযানের ঘটনায় নগরী ও জেলার চার থানায় সন্ত্রাস দমন ও অস্ত্র আইনে পাঁচটি মামলা হয়েছে। সবগুলো মামলাই তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে বলে র্যাব জানায়।