তিস্তায় ব্যর্থতায়’ও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ইতিবাচক হলেও সাফল্য ম্লান
লাবণ্য চৌধুরী : তিস্তায় ব্যর্থতায়’ও প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ইতিবাচক হলেও সাফল্য ম্লান হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকরা।’কূটনৈতিকরা বলছেন, নানা দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হলেও দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বিচারে বর্তমান সরকারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফর খুব বেশি ইতিবাচক হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন এবং গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা বা চুক্তি না হওয়ায় সরকারবিরোধীরা বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করে চেষ্টা করবে সুবিধা নেওয়ার।’
গত শনিবার দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এক ব্রিফিংয়ে জানান, দু’দেশের মধ্যে ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুই সচিবের ব্রিফিং থেকে স্পষ্ট হয় ২২টি চুক্তি এবং ১৪টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক পাঁচটি, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা সম্পর্কিত চারটি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্যাটেলাইট ব্যবহার বিষয়ক তিনটি চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন, তথ্যপ্রযুক্তি, সীমান্ত নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে স্বাক্ষরিত চুক্তি, সমঝোতা, আলোচনা এবং বৈঠক পরবর্তী বক্তব্যের তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘এবারের সফরে দু’দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন কিছু রূপরেখা এসেছে। যেমন- প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক পারমাণবিক সহায়তার রূপরেখা। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের আস্থার সম্পর্কের দৃঢ় প্রতিফলন ঘটেছে।’ তিনি বলেন, ‘চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তি আগেই হয়েছে। ভারতের সঙ্গেও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আগে থেকেই ছিল।
দু’দেশের মধ্যে যৌথ মহড়া, প্রশিক্ষণ বিনিময়, দুর্যোগ মোকাবেলা সহায়তাসহ অনেক বিষয়েই সহযোগিতা ছিল। কিন্তু এবারের চুক্তির মধ্য দিয়ে আসলে দু’দেশের এই সহযোগিতার বিষয়গুলোকে একটি রূপরেখা বা কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসা হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিক করা হয়েছে। ফলে দু’দেশই উপকৃত হবে। প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ভারত থেকে অস্ত্র কিনলেও তা দেশের জন্য ইতিবাচক হবে। কারণ অন্য দেশের তুলনায় কম টাকায় তা পাওয়া যাবে। চীন থেকে অস্ত্র কেনার চুক্তি হলে ভারতের সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনা।’
ওয়ালিউর রহমান বলেন, ‘রাশিয়ার সহায়তায় বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র করছে। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশে যথেষ্ট দক্ষ বিশেষজ্ঞ জনবল না থাকায় ভারতের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তি হওয়ায় বাংলাদেশ লাভবান হবে। কারণ বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারে ভারত বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ। এতে বাংলাদেশ, ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া অন্য বিষয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, তাও বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে এবং এতে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।
সাবেক কূটনীতিক ও সচিব ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সফরে ভারত সর্বোচ্চ সৌহার্দ্য এবং শিষ্টাচার দেখিয়েছে। সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথা বলেছে, এগুলো ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর নিশ্চয়ই দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে অন্যদিক থেকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারগুলো এ সফর থেকে অর্জিত হয়নি। যেমন, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা, তিস্তার পানি বণ্টন, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট ফল আসেনি। সীমান্তে হত্যা বন্ধ নিয়েও কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। বাণিজ্য ক্ষেত্রে ভারতের ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক বাধা দূর করার বিষয়েও কোনো ফল দেখা যায়নি। যদিও প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এসব বিষয় আলোচনায় এনেছেন। এ কারণেই বলছি, বাংলাদেশের অগ্রাধিকারগুলোতে ইতিবাচক ফল আসেনি।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে কিংবা আরও ভালো হবে- এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের এ সফরে যেসব চুক্তি হয়েছে, তার শর্তগুলো এখনও জানা যায়নি। সেগুলো জানা গেলে এ বিষয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের দেওয়া প্রথম এক বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তগুলো খুব ভালো ছিল না। আশা করব, এবার পাঁচ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তগুলো ইতিবাচক হবে এবং এ সহায়তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা এবং সমঝোতা অবশ্যই বড় কূটনৈতিক অগ্রগতি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, সেগুলোও খুবই ইতিবাচক। কিন্তু এ থেকে বাস্তবে কী সুফল পাওয়া যাচ্ছে, সেটা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের পর্যায়ে। এ বিষয়টি নির্ভর করবে কূটনৈতিক যোগ্যতার ওপর। কারণ দু’দেশের সম্পর্ক চলমান, ধারাবাহিকভাবে এটা চলবে। কিন্তু এই ভালো সম্পর্ক ধারাবাহিক রাখা এবং সেখান থেকে ইতিবাচক ফল নিয়ে আসা অবশ্যই কূটনৈতিক যোগ্যতার ওপরই নির্ভর করে।’ তিস্তা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মানুষ তিস্তার বিষয়ে একটি নিশ্চিত কিছু জানতে আগ্রহী। যেহেতু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুনির্দিষ্টভাবে একটি কথা বলেছেন, সে কারণে আশাবাদ রাখা যেতেই পারে। কিন্তু এটা দীর্ঘায়িত হোক, সেটাও কাম্য নয়।
কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে এগুলো কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। কারণ মানুষ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দেখতে চায়, গঙ্গা ব্যারাজের নির্মাণ নিয়ে সুস্পষ্ট অগ্রগতি দেখতে চায়। এ বিষয়গুলো এখন রাজনীতির ইস্যু। তাই এসব বিষয়ে কোনো ফল না আসার অর্থ- নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে প্রধানমন্ত্রীর এ সফর থেকে সরকারি দল খুব বেশি সুবিধা পাবে না।
বরং বিরোধীপক্ষ ইস্যুগুলোকে আরও বড় করে তুলে ধরে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা চালাবে।’ তিনি বলেন, ‘দিলি্লর নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশের রাজনীতির এ বিষয়গুলো খুব ভালো করেই জানেন। সত্যিকার অর্থে বর্তমান সরকারের হাত শক্তিশালী করতে চাইলে তাদের উচিত ছিল তিস্তা কিংবা গঙ্গা ব্যারাজের মতো ইস্যুতে সুস্পষ্ট কিছু করা। কিন্তু উল্টো মমতা তিস্তা বাদ দিয়ে অন্য নদীর পানি বণ্টনের কথা বলতে চাইছেন। মনে হচ্ছে তিনি তিস্তা ভুলে গিয়ে অন্যকিছু নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিচ্ছেন। মমতার এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বরং তা দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়াবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর এ সফর প্রতিবেশী দুই বন্ধুরাষ্ট্রের সম্পর্ককে আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, পারস্পরিক আস্থা বাড়িয়েছে। যেসব চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, সেগুলো দু’দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও সম্প্রসারিত করবে। সার্বিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরে কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে দুই দেশ আরও অনেক কাছে এসেছে।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মধ্যে যে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছিল, এ সফরে তাও দূর হয়েছে বলে আশা করা যায়।’ তিনি বলেন, ‘দুই দেশের বর্তমান সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে’- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ বক্তব্যকে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তার এ বক্তব্যের বাস্তবায়ন যেন দ্রুত হয়, সে জন্য বাংলাদেশকে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে।’