জিয়া এতিমখানা’র তোলপাড় কান্ড!
সরেজমিনে সাইফুল বারী মাসুম / শহিদুল ইসলাম : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের এতিমখানা’ দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। তিনি আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছিলেন, বাগেরহাটে অনুদানের টাকায় জিয়া এতিমখানা সুন্দর ও সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এতিমখানায় বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৩ জন এতিম। ওদিকে বগুড়ায় এতিমখানার অস্তিত্ব নেই; তবে ওই জমি দখল করা হয়েছিল তারেক জিয়ার নামে। ওই জমির দাম এখনো পাননি ভূমির মালিক।
জিয়া এতিমখানার জমি জোরজবস্তি দখলকরা হয়েছে বলে এর মালিক অভিযোগ করেছেন অনলাইন দৈনিক জাতিরকন্ঠ প্রতিনিধির কাছে। জমির মালিক বলেছেন, বগুড়ায় জিয়া এতিমখানার জমি তিনি বিক্রি করেননি। এই জমি তারেক জিয়ার নামে ভয় দেখিয়ে দখল করে নেয়া হয়েছে। এনিয়ে নিরীহ পরিবারটি গত প্রায় ১৫ বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ধর্ণা দিয়েও কোন সুফল পাননি।
ওদিকে বেগম জিয়ার আইনজীবীরা এই জমির সপক্ষে যে কাগজপত্র দাখিল করেছেন আদালতে, সেখানে দেখা যাচ্ছে জমির বায়নায় লেখা আছে, এটি ‘জনগণ’ এর জমি! অথচ তারেক জিয়ার দখল করা এই জমিটি নিয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা’র রায় হচ্ছে ৮ ফেব্রুয়ারি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় ১০ বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকএই দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। ১০ বছর ধরে চলছে এই মামলা। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারণ করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। এদিকে বিএনপি নেতারা আন্দোলনে যতোটা সক্রিয় ততোটা সক্রিয় নয় ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের এতিমখানা’ প্রকৃত অবস্থান জানাতে। বিএনপি নেতার বরং কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে উত্তর দিতেও বিব্রতবোধ করে ব্যস্ততা দেখিয়েছেন।
তবে খালেদা জিয়া গত বছরের ১৬ নভেম্বর ওই মামলার বিচারাধীন আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘বাগেরহাটে অনুদানের টাকায় ট্রাস্টের (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট) মাধ্যমে স্থাপিত এতিমখানা সুন্দর ও সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আরও জানতে পেরেছি, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট বগুড়ায় এতিমখানা স্থাপনের লক্ষ্যে জমি ক্রয় করে।
এই জমি কেনা সম্পর্কেও কোনো রকম অনিয়মের অভিযোগ নেই। এই ট্রাস্টের বাকি টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে এবং তা সুদাসলে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।’পরে অনুসন্ধানে বাগেরহাটে কোনোরকমে চলছে এমন একটি এতিমখানার অবস্থান পাওয়া যায় এবং বগুড়ায়ও জমি ‘কেনার’ খোঁজ মেলে। তবে, দলটির আলোচিত নেতা মওদুদ আহমেদ সরলভাবে বলেন, এতিমখানা তো হয়নি!
এদিকে বিশাল তোলপাড় করা মামলার মূল বিষয়বস্তু ওই এতিমখানাটির অবস্থান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন নিজের টাইম লাইনে লেখেন, ‘আই অ্যাম লুকিং ফর এতিমখানা। জিয়া এতিমখানাটা কোন দিকেরে ভাই?’ এই স্ট্যাটাসটিও বহু শেয়ার হয়।আরও জানা যায়, জিয়া এতিমখানার জন্য বগুড়ায় জমি কেনা হয়েছিল। সেখানে সাইনবোর্ডও ঝোলানো হয়েছিল। তবে এতিমখানাটির জন্য যাদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল তাদের প্রাপ্য টাকা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি বলে জমির মালিকরা অভিযোগ করছেন।
তবে জাতিরকন্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপি আমলে কাতারের আমীর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানকেও অর্থ সহায়তা পাঠান। সেই টাকায় বাগেরহাটে মোস্তাফিজুর রহমানের জমিতে একটি এতিমখানা নির্মাণ করা হয়। অথচ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলের টাকা কীভাবে এতিমদের জন্য ব্যয় হবে সেটার কোনো ধরনের নীতিমালা তৈরি করা হয়নি! তবে, সেই টাকার সুদে-আসলে বেড়েছে। এতিমের টাকায় ফুলেফেঁপে উঠেছে ক্ষমতাশালীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট।
বাগেরহাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র ৩ জন দুস্থ আর নামমাত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিয়ে চলছে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের এতিমখানা। এতিম ও দুস্থদের লালন-পালন ও স্বাবলম্বী করার জন্য জেলার সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে ১৯৯৪ সালে ৩ দশমিক ৯০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট।
ওই বছরের ২৩ জুন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট অফিস ভবন, ৩০ শয্যাবিশিষ্ট দ্বিতল আবাসিক ভবন, ১৮ কক্ষবিশিষ্ট দ্বিতল প্রশিক্ষণ ভবন, একটি একতলা ক্লিনিক ভবন ও মসজিদ দিয়ে শুরু হয় এতিমখানাটি। শুরুতে ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী ছিল। তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো দিনই ক্লিনিকটি চালু হয়নি।
কিন্তু এখন আর তেমন কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে এতিমখানাটির। নানা অব্যবস্থাপনায় যখন দুস্থ ও এতিমরা আর ভর্তি হচ্ছিল না এখানে তখন কর্তৃপক্ষ ২০০০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে মহিলা প্রশিক্ষণ ও ফিডার স্কুল চালু করে।জিয়া অরফানেজের অধ্যক্ষ আফতাব আলম জাতিরকন্ঠকে বলেন, ২০০০ সালে এখানকার দায়িত্বে এসেছি। তারপর থেকে প্রতি মাসে যে খরচ হয় তা স্যারের (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান) ছেলে পাঠাত। এখন তিনি আমেরিকায় থাকেন। আমেরিকায় যাওয়ার পর থেকে হিসাবরক্ষক হাসান সাহেব প্রতি মাসে কুরিয়ারে খরচের টাকা পাঠিয়ে দেন। বর্তমানে প্রতি মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়।
বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে আফতাব আলম বলেন, এখানে একজন করে অধ্যক্ষ, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, ইমাম, বাবুর্চি ও ২ জন গার্ড আছে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২৬২ এতিম ও দুস্থ এখান থেকে পড়াশুনা করে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আছে মোটে ৩ জন দুস্থ। যাদের দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু আছে, সেখানে ২২ জন শিশু পড়াশুনা করছে। মহিলাদের দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষণে ১৫ জন প্রশিক্ষণার্থী আছে। সকালে মসজিদে স্থানীয় শিশুদের কোরআন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক কানিজ ফাতেমা মোস্তফা জাতিরকন্ঠকে বলেন, আমাদের নিবন্ধিত এতিমখানার তথ্য বাদে অন্য কোনো এতিমখানার তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। জিয়া মেমোরিয়াল অরফানেজ ট্রাস্টের এতিমখানার ব্যাপারে কিছু জানা নেই। তবে শুনেছি বর্তমানে সেখানে অবস্থান করছে মোটে ৩ জন দুস্থ। যাদের দর্জি বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিচ্ছে ২২ জন শিশু, ১৫ জন মহিলাদের দর্জি’র কাজ শিখছে।
এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে ও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতা তারেক রহমানসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়।