• শুক্রবার , ২২ নভেম্বর ২০২৪

জাতীয় সংগীত ও সংবিধান পাল্টাতে আলোচনা


প্রকাশিত: ১০:৫১ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর ২৪ , বুধবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৯ বার

বিশেষ প্রতিনিধি : এবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা চলছে। জাতীয় সংগীত একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের প্রতীক।এটি সামনে নিয়ে আসছেন একাধিক বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্টজন। ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমীও একই সঙ্গে জাতীয় সংগীত সংবিধানের ও পরিবর্তন দাবি করেছেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ইতিপূর্বে বেশ কয়েকটি দেশ সমসাময়িক মূল্যবোধ এবং জাতিগত অন্তর্ভুক্তিকে আরও জোরদার করতে নিজ নিজ জাতীয় সংগীতে সংশোধন ও পরিবর্তন আনার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশেও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে আলোচনা এখন তুঙ্গে।মধ্য জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন সপ্তাহের ব্যবধানে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। এই প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর বেরিয়ে আসতে থাকে হত্যা-খুন-গুমসহ রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের নজীরবিহীন সব তথ্য।

ছাত্র-জনতার সুপারিশে ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। এসময় আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কার এবং মেরামতের দাবি জোরালো হয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংবিধান পরিবর্তনের দাবি উঠে। ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দলগুলো যেন ফের স্বেরাচারী হয়ে না উঠতে পারে তা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। একই সময় আলোচনায় আসে জাতীয় সংগীতে পরিবর্তনের বিষয়টি।

এদিকে গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধানের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপরই এই প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে উঠে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইতোমধ্যে নেটিজেনরা বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে এখানে সবারই পরামর্শ-দাবি বিবেচনা করা যেতে পারে। আবদুল্লাহিল আমান আযমী একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন এটি গ্রহণ করা না করার বিষয়ে সরকার আলোচনা করতে পারে। আরেকটি পক্ষ বলছে, জাতীয় সংগীত আমাদের আবেগের জায়গা। এটি পরিবর্তন করার দাবি কিসের ভিত্তিতে তিনি তুলবেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি। এতে স্বাধীন-স্বার্বভৌম বাংলাদেশের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।’আমান আযমী বলেন, ‘১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?

তিনি আরও বলেন, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদায় থাকা অবস্থায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে বরখাস্ত হন আমান আযমী। ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরবর্তী আট বছর তাকে আয়নাঘরে (সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার গোপন আস্তানা) আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের দিন তাকে একটি নির্জন স্থানে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেয়া হয়।

তার গুমের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, দুটি কারণে আমাকে তারা গুম করে রেখেছিল। আমার পৈত্রিক পরিচয় এবং আমি ভারতবিরোধী। জাতীয় সংগীতের প্রসঙ্গে তিনি দাবি করেন, তখনকার ভারতীয় সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের উপর তাদের জনপ্রিয় কবির রচিত কবিতা জাতীয় সংগীত হিসেবে চালিয়ে দেন।

এ প্রসঙ্গে, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে সংবাদকর্মী মোহসীন কবীর বলেন, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার- এই গানটি আমার কাছে জাতীয় সংগীত হিসেবে সর্বোত্তম মনে হয়। এর কথাগুলো যেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক। গানটি লিখেছেনও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি যুদ্ধের ময়দানে বসেই এটি রচনা করেছেন। এর গীতিকার জাতীয় এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু। গানটি গেয়েছেন বাংলাদেশের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি কোকিলকণ্ঠী গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন। গানটিতে বাংলাদেশ নামটিও রয়েছে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার লেখা গানইতো হওয়া উচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আর হ্যাঁ, সংবিধান পরিবর্তন কিংবা পরিমার্জন করা গেলে জাতীয় সঙ্গীতও পরিবর্তন করা যায়। দেশের প্রয়োজনে সবই করা যায়।’
বিশ্বের একাধিক দেশে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। লিঙ্গবৈষম্য বাতিল করে লিঙ্গসমতা আনতে, আদিবাসীসহ জাতিগত বিভেদ মুছে ফেলে অর্ন্তভুক্তির আমেজ আনতে তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে।

সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনের বরাতে এবার একনজরে দেখে নেয়া যাক এসব সব দেশগুলো কোন প্রেক্ষিতে এবং কীভাবে তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে। অস্ট্রিয়া-২০১২ সালে লিঙ্গ সমতা আনার জন্য অস্ট্রিয়ার জাতীয় সংগীতে ‘ছেলেরা’-এর জায়গায় ‘মেয়েরা এবং ছেলেরা’ লেখা হয়।
কানাডা-উত্তর আমেরিকার এই দেশটিও সম্প্রতি তাদের জাতীয় সংগীতকে আরো লিঙ্গ নিরপেক্ষ করতে সংগীতের দ্বিতীয় লাইনে ‘তোমার সব ছেলেরা’-এর জায়গায় লেখা হয়েছে ‘আমরা সবাই’।
নেপাল- ২০০৮ সালে নেপালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। তার আগের বছর নেপালে নতুন একটি গানকে জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৬২ সালে গ্রহণ করা নেপালের আগের জাতীয় সংগীতে রাজতন্ত্রের প্রশংসা ছিল। তাই এতে পরিবর্তন আনা হয়।

আফগানিস্তান-দেশটিতে বেশ কয়েকবার জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনা হয়। তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে কোনো জাতীয় সংগীতই ছিল না। পরে ২০০২ সালে পুরোনো জাতীয় সংগীতকে ফিরিয়ে আনা হয়। পরে ২০০৬ সালে তখনকার কারজাই সরকার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে জাতীয় সংগীতও পরিবর্তন করে।
রুয়ান্ডা-আফ্রিকার এই দেশটির কথা উঠলেই গণহত্যার কথা মনে পড়ে। ১৯৯৪ সালে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ওই দেশে পাঁচ থেকে ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। গণহত্যা পরবর্তী রুয়ান্ডার ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে দেশটি ২০০১ সালে একটি নতুন জাতীয় সংগীত বেছে নেয়।

দক্ষিণ আফ্রিকা-দেশটি ১৯৯৭ সালে আগের দু’টি জাতীয় সংগীত থেকে কিছু অংশ নিয়ে নতুন একটি জাতীয় সংগীত তৈরি করে। আফ্রিকান ও ইংরেজি ভাষায় গানটি রচিত। তবে আফ্রিকান ভাষার অংশটি বর্ণবাদ আমলে ব্যবহৃত জাতীয় সংগীতের অংশ হওয়ায় এর সমালোচনা করেন অনেকে। নেলসন ম্যান্ডেলা সেটি রিকনসিলিয়েটরি ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

রাশিয়া-ভ্লাদিমির পুটিন ২০০০ সালে রুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর ১৯৯০ সালের আগে ব্যবহৃত জাতীয় সংগীত ফিরিয়ে আনেন। তবে গানের কথায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৯০ সালে যে জাতীয় সংগীত গ্রহণ করা হয়েছিল তাতে কোনো কথা না থাকায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া অ্যাথলিটরা এর সমালোচনা করেছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল, কথাবিহীন গান তাদের নাকি উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি।

জার্মানি-দেশটির সমতাবিষয়ক কমিশনার ক্রিস্টিন রোজে-ম্যোরিং জাতীয় সংগীতে আরো বেশি লিঙ্গ সমতা আনার প্রস্তাব করেন। সংগীতের যে অংশে ‘ফাটারলান্ড’ অর্থাৎ ‘পিতৃভূমি’ বলা হচ্ছে, সেখানে ‘হাইমাট’ অর্থাৎ ‘জন্মভূমি’ লেখার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। তবে তখনকার চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ অনেকেই মনে করছেন, জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন নেই।

অস্ট্রেলিয়া-প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের ঘোষণার পর ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের জাতীয় সংগীতের একটি ভিন্ন সংস্করণ চালু করেন। নতুন এ জাতীয় সংগীতে অস্ট্রেলিয়াকে আর ‘ইয়াং অ্যান্ড ফ্রি’ হিসেবে আর অভিহিত করা হবে না। আদিবাসীদের সুদীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটানোর অংশ হিসেবেই এ পরিবর্তন আনা হয়।