• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ছাগলকান্ডে গরু মাফিয়া


প্রকাশিত: ৯:১৩ পিএম, ২ জুলাই ২৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৬০ বার

ইমরানের ব্রাহমা চালবাজির নেপথ্যে প্রাণী সম্পদ কর্তারা-

 

লাবণ্য চৌধুরী : বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু চালবাজি করে হাতিয়ে নিয়েছিল ছাগলকান্ডের সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক সেই ধুরন্ধর ইমরান। কাস্টমস বিভাগ বিমানবন্দরে গরু জব্দ করে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কে দিলেও সে গরু পুনরায় হাতিয়ে নিয়েছে ইমরান। এজন্য প্রাণী সম্পদ অধিদফতরের একাধিক রাঘববোয়াল জড়িত রয়েছে। যাদের মোটা অংকের বকশিশ দিয়ে কোটি কোটি বানিয়েছে ইমরান। এরমধ্যে ৩টি ব্রাহমা গরু বিক্রি করেই সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে।

ছাগল-কাণ্ডে আলোচনায় আসা খামার সাদিক অ্যাগ্রো। এর মালিক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। তিনি গবাদিপশুর খামারমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি। অনুমতি না থাকা ও খালের জায়গা দখল করায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) গত বৃহস্পতি ও শনিবার অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদপুরে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার ভেঙে দেয়।২০২১ সালের ৫ জুলাই ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮টি ব্রাহমা জাতের গরু জব্দ করে ঢাকা কাস্টম হাউস। পরে সেগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হেফাজতে সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাংস বেশি হয় ব্রাহমা জাতের গরুর। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে, জাতটির উৎপত্তি ভারতে হলেও পরে যুক্তরাষ্ট্র দুই থেকে তিনটি জাতের সংমিশ্রণে এটিকে উন্নত করেন। এর ফলে ব্রাহমা জাতের গরুর ওজন হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার কেজি। অথচ দুই থেকে আড়াই বছরের দেশি গরুর ওজন ২৫০ থেকে ৩৫০ কেজি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, এই গরু বাংলাদেশে পালনের অনুমতি দেওয়া হলে দুধ বেশি দেওয়া গরুর পালন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ব্রাহমা নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ঢাকা কাস্টম সাদিক অ্যাগ্রোর ১৮টি গরু জব্দ করার পর তারা উচ্চ আদালতে রিট করেছিল। তবে উচ্চ আদালতের রায় তাদের বিপক্ষে যায়। তার পর থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সাভারেই গরুগুলো ছিল।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, গত পবিত্র রমজানে অধিদপ্তরের উদ্যোগে ঢাকায় কিছুটা কম দামে দুধ, ডিম ও মাংস বিক্রি করা হয়। সেখানে এবার মাংস সরবরাহ করেছে ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন। মোট চাহিদার অর্ধেক মাংসবাবদ কম দামে (জীবন্ত অবস্থায় ভ্যাটসহ কেজিপ্রতি ২৯৩ টাকা) ৪৮৮টি গরু সরবরাহ করা হয়েছিল প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিভিন্ন খামার থেকে। এর মধ্যে ১৫টি ব্রাহমা গরু ছিল। বাকি তিনটি মারা গেছে। জানা গেছে, দুই থেকে আড়াই বছরের দেশি গরুর ওজন যেখানে ২৫০ থেকে ৩৫০ কেজি হয়, সেখানে ব্রাহমা জাতের গরুর ওজন হয় ৮০০ থেকে ১ হাজার কেজি।

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক গনমাধ্যমকে বলেন, গরুগুলো বিক্রির সব প্রক্রিয়া আগের মহাপরিচালক করে গেছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে এর আগে মহাপরিচালক ছিলেন মো. এমদাদুল হক তালুকদার। তিনি গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান। বর্তমান মহাপরিচালকের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। তাঁর কাছে নথিপত্র নেই। নথিপত্র না দেখে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান রমজান মাসে মাংস বিক্রির নামে গরুগুলো কিনলেও তিনি তা করেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, ব্রাহমা গরু রেখে দিয়ে তার বদলে অন্য গরুর মাংস সরবরাহ করেন ইমরান। পরে পবিত্র ঈদুল আজহার বাজারে বিপুল দামে ব্রাহমা গরুগুলো বিক্রি করেন। ইমরান হোসেন বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাছ থেকে কিনলেও শর্তে এমন কিছু উল্লেখ ছিল না যে ব্রাহমা গরুগুলো মাংস হিসেবেই বিক্রি করতে হবে।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠে গত রমজানের পরপরই (১৮ ও ১৯ এপ্রিল) গবাদিপশুর মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে সাদিক অ্যাগ্রো ১ হাজার ৩০০ কেজি ওজনের ব্রাহমা জাতের একটি গরু এক কোটি টাকা দাম হাঁকিয়ে আলোচনায় আসে। ঈদুল আজহার আগে ব্রাহমা গরু বিপুল দামে বিক্রির কথা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইউটিউবারের কাছে বলেছেন ইমরান।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উচ্চবংশীয় বলে দাবি করে তিনটি ব্রাহমা জাতের গরু ২ কোটি ৬০ লাখ টাকায় বিক্রির কথা জানান ইমরান। একটির ওজন বলেন ১ হাজার ৪০০ কেজি। আরেকটির ওজন ১ হাজার ৩০০ কেজি। তৃতীয়টির ওজন জানা যায়নি। তিনটির মোট ওজন সাড়ে তিন হাজার কেজি ধরে হিসাব করে দেখা যায় যে জীবন্ত অবস্থায় কেজিপ্রতি দাম হয় ৭ হাজার ৪২৯ টাকা। অথচ ইমরান কিনেছেন কেজিপ্রতি ২৯৩ টাকায়।

সাদিক অ্যাগ্রোর ব্রাহমা গরু রেখে দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ‘তাঁর (ইমরান হোসেন) কাছে মাংস চেয়েছি যে এত মণ দেবেন। আমরা তা বুঝে নিয়েছি। কোন গরুর মাংস তিনি দিয়েছেন, তা মেলানো সম্ভব হয়নি।’

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের পুরাতন বাণিজ্য মেলা মাঠে গত রমজানের পরপরই (১৮ ও ১৯ এপ্রিল) গবাদিপশুর মেলার আয়োজন করা হয়। সেখানে সাদিক অ্যাগ্রো ১ হাজার ৩০০ কেজি ওজনের ব্রাহমা জাতের একটি গরু এক কোটি টাকা দাম হাঁকিয়ে আলোচনায় আসে। ঈদুল আজহার আগে ব্রাহমা গরু বিপুল দামে বিক্রির কথা বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ইউটিউবারের কাছে বলেছেন ইমরান।অবশ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গতকাল সোমবার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে অভিযান পরিচালনা করেছে। সেখান থেকে দুদকের দলটি সাভারের বিরুলিয়ায় সাদিক অ্যাগ্রোর খামারেও যায়।

বিমানবন্দরে ব্রাহমার চালান আটকের সময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকায় কাজী রফিকুজ্জামান বিষয়গুলো দেখভাল করেছিলেন। চালান জব্দের পর কাজী রফিকুজ্জামানকে বদলি করে দেওয়া হয়। তাঁকে প্রথমে নোয়াখালীর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এবং পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে অবস্থিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডিপ্লোমা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ করে পাঠানো হয়।

এখনো তিনি সেখানেই কর্মরত।অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একাংশের দাবি, চালান আটক নয়, অনিয়মের দায়ে কাজী রফিকুজ্জামানকে বদলি করা হয়েছিল। তবে অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের যে অংশ ইমরানের বিরোধী, তাদের দাবি হলো, রফিকুজ্জামানকে বদলি করার পেছনে ছিল ব্রাহমা গরু জব্দ। কারণ হিসেবে অন্য কিছু দেখানো হয়েছিল।
কাজী রফিকুজ্জামান বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, প্রাণিসম্পদ খাতে সাদিক অ্যাগ্রো খুবই প্রভাবশালী। শুধু ব্রাহমা গরু নয়, এ খাতের প্রকল্প, অনুদানসহ নানা বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। দুদকের উচিত পুরো বিষয়টি তদন্ত করা।