চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই সফল হবে হুদা কমিশন!
এস রহমান : সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ নতুন ইসির ।এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই সফল হবে হুদা কমিশন।এ আশাবাদ দেশের বিজ্ঞ মহলের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এই কমিশনের মেয়াদে। এর আগেই অন্তত সাতটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ বেশ কিছু নির্বাচন হবে।
বিজ্ঞ মহলের মতে, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই পা ফেলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন কমিশনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নিতে যাচ্ছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে. এম. নুরুল হুদা ও অন্য চার নির্বাচন কমিশনার।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে নতুন ইসির যাত্রা শুরু হচ্ছে। এ পরিস্থিতিকেই নানা চ্যালেঞ্জের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে নির্বাচন বর্জন ও ঠেকানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়ে পড়ে বলে মনে করেন বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মো. আবু হাফিজ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ পাওয়া কে. এম. নুরুল হুদা অবশ্য এই চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে নিয়েই বলেছেন, দেশে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, দেশবাসীর সমর্থন ও সহযোগিতা থাকলে ইসিকে আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন।
নির্বাচন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের পরই নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছিল কাজী রকিবউদ্দীনের কমিশন। এরপর উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজন করতে গিয়ে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তারা। নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে সন্দেহ-অবিশ্বাসের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণে প্রথম দিন থেকেই কাজ করতে হবে নতুন ইসিকে।
ইসি কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নতুন কমিশনকে কুমিল্লা, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের শূন্য ঘোষিত গাইবান্ধা-১ ও সুনামগঞ্জ-২ আসনের উপনির্বাচন হবে। এসব নির্বাচনের মাধ্যমেই বর্তমান কমিশন জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনার সুযোগ পাবে।
১৬ বিশিষ্টজন অনুসন্ধান কমিটিকে নতুন নির্বাচন কমিশনারদের গুণাবলি সম্পর্কে একবাক্যে বলেছিলেন, তাদের সৎ, দলনিরপেক্ষ, সাহসী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। নতুন সিইসি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
বিশিষ্টজন অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়কে আরও দক্ষ ও সম্প্রসারণেরও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারা এই মর্মে আশা প্রকাশ করেছিলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করবে। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুরো কমিশনকে আদালতে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। নির্বাচন কমিশনারদের পারস্পরিক সম্পর্কে যাতে কোনো টানাপড়েন প্রশ্রয় না পায়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। অতীতে এর নিদর্শন রয়েছে।
ইসি কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাঠ পর্যায়সহ নির্বাচন কমিশনে ছয় শতাধিক কর্মকর্তার নিয়োগবিধি ও পদোন্নতি নিয়ে যে জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা নিরসন করতেও নতুন কমিশনকে অনেক বেগ পেতে হবে। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পৃথক করে স্বাধীন ইসি সচিবালয় আইন হলেও পরবর্তী সময়ে এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় অনেক জটিলতা তৈরি হয়, যার প্রভাব পড়েছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে। কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত থাকছেন।
বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া :সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন নতুন ইসির সামনে চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলেন, প্রথমেই তাদের আন্তরিকতা প্রমাণ করতে হবে। যে যা-ই বলুক, দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাজনৈতিক বিরোধের কারণে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের বিষয়টি মেনে নিলেও স্থানীয় সরকারের অন্যসব নির্বাচনেও মানুষ ভোট দিতে পারেনি।
ভোটকেন্দ্রে গিয়ে মানুষ ভোট দিতে পারবে, সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, নতুন কমিশনের সামনে দুটি মডেল রয়েছে। হুদা কমিশনের মডেল তারা অনুসরণ করতে পারে, আবার সদ্য বিদায়ী রকিব কমিশনের মডেলও অনুসরণ করতে পারে।
তারা কোনটা অনুসরণ করবেন, সেটাই দেখার বিষয়। আবার তারা নতুন মডেল তৈরি করতে পারেন। তিনি বলেন, কমিশন সচিবালয়ের অভ্যন্তরেও কিছু চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতে হবে। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গড়তে নিয়োগবিধি, পদোন্নতিসহ বেশ কিছু বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের ওপর দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। নতুন ইসির দু’জন সদস্য এর আগে ইসি সচিবালয়ে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তারা কাজে লাগাতে পারলে ইতিবাচক কিছু করা সম্ভব হবে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলের আচরণের ওপর। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা পেলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই নির্বাচন কমিশন সফল হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এই কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে এ চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল, সরকার ও জনগণের সমর্থন এবং কার্যকর সহযোগিতাই তাদের সফলতার বিষয়টি নির্ধারণ করবে। একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় নতুন ইসি গঠিত হওয়ায় তারা জনগণের আস্থা অর্জন করে সফল নির্বাচন উপহার দেবেন, সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন তিনি।
নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ আছে বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান বাস্তবতার বিচারে অবশ্যই বড় চ্যালেঞ্জ। এই কাজ নতুন কমিশনকে করতে হবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন আস্থার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে_ এটাই প্রত্যাশা থাকবে। তবে যাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন ছাড়া অন্যদের তিনি চেনেন না। তিনিসহ বিশিষ্টজন পরামর্শ দিয়েছিলেন, সাহসী, দৃঢ়, দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত রয়েছে এমন ব্যক্তিদের দিয়েই নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য। পরে সার্চ কমিটি নামগুলো সুনির্দিষ্ট করেছে। তবে নাম চূড়ান্ত করার পর তাদের কোন কোন যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। তারা কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে অবশ্যই প্রত্যাশা থাকবে, তারা দায়িত্ব পালনে সফল হবেন।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, যাদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের তিনি চেনেন না। তবে একটি পত্রিকা পড়ে জেনেছেন, যিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছেন, তিনি ১৯৯৬ সালে তখনকার ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে জনতার মঞ্চে যোগ দিয়েছিলেন।
এ কারণে তিনি মনে করেন, তার এখন এত বড় দায়িত্ব না নেওয়াই ভালো ছিল। তিনি বলেন, যেহেতু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দু’জনেই বলেছেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, সে কারণে ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য ও অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। অবশ্যই আশা থাকবে, এই নির্বাচন কমিশন অতীতের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করবে না; বরং জাতির প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিতে পারে এমন নির্বাচন করবে।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনে নিরপেক্ষ, যোগ্য, নীতিবান, সাহসী, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই এসেছেন। অবশ্যই প্রত্যাশা করা যায়, রাজনৈতিক সরকারের আমলে দক্ষতার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করে এই নির্বাচন কমিশন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের চ্যালেঞ্জে সফল হবে। কাজের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করবে, তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, প্রত্যাশা ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন, যারা জনগণের আস্থায় থেকে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। যাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন হয়েছে, তাদের চিনি না, সে কারণে তাদের ভবিষ্যৎ সফলতার বিষয়ে মন্তব্য করা খুবই কঠিন। তবে অবশ্যই আশা করব, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের যে প্রত্যাশা রয়েছে, তা পূরণে তারা সফল হবেন। এটাই এখন তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
পুুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন কেবল গঠন করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি নির্বাচন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ থাকে গ্রহণযোগ্য সফল নির্বাচন করা। প্রত্যাশা থাকবে, তারা দায়িত্ব পালনে আস্থা অর্জন করবেন এবং সফল হবেন।