চার মেধাবীর আর্তনাদ-স্বপ্ন পূরণে কে সহায়তা দেবে?
আসমা রহমান/নীপা খন্দকার :
চার মেধাবীর আর্তনাদ-স্বপ্ন পূরণে কে সহায়তা দেবে? নানা প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে এ বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা সবাই। ৩০ মেতেও কাকডাকা ভোরে বাবার সঙ্গে প্রতিবেশীর জমির ধান কাটতে গিয়েছিল শোভন কুমার। দিনটি ছিল এসএসসির ফলাফল ঘোষণার।
নাটোরের কালীগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দেওয়া শোভন দুপুরে বাড়ি ফিরে জানতে পারে, জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। অবশ্য এ ফলাফলেও তার বা পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়নি।
যমুনায় ঘর ভেঙেছে। তাই বাঁধের ওপর ছোট্ট ঘর তুলে তাতেই কোনোরকমে মাথা গোঁজা। বাবা ভ্যান চালান, ভ্যান চালায় ছেলেও। দুজনের ঘাম ঝরানো সামান্য আয়েই সংসারের ঘানি টানা; ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালানো। নদীতে ঘর ভাঙলেও ভাঙতে পারেনি তাঁদের মনোবল। বাবা-ছেলের এ অদম্য সংগ্রামে অবশেষে জয় হয়েছে আলী হাসানের।
সিরাজগঞ্জের হাসানের মতো চাঁপাইনবাবগঞ্জের চিন্তা, নাটোরের শোভন আর পঞ্চগড়ের মাহফুজার ঘর নদীতে ভাঙেনি ঠিকই, কিন্তু তারাও প্রায় ভূমিহীন পরিবারেরই সন্তান। নানা প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে এ বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা সবাই।
ভ্যানগাড়িচালক বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ : সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী গ্রামের আলী হাসান ঠুটিয়া উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাবা রশিদ শেখ ভ্যানচালক। মা চানভানু খাতুন অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। দরিদ্র সংসারে তিন ভাই, এক বোনের মধ্যে আলী হাসানই ছোট।
সংসারের পাশাপাশি লেখাপড়ার খরচ জোটাতে হাসান স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন বিকেল থেকে ভ্যান চালাত। ছুটির দিন চালাত সারা দিন। সম্প্রতি হাসানের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, একটি টিনের কাঁচা ঘরে চৌকি পেতে তাঁদের বসবাস। নেই বিদ্যুৎ। নেই পড়ার চেয়ার-টেবিল। এখানেই রান্না, খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা— সব।
এ ঘরে হাসান কীভাবে লেখাপড়া করেছে—এমন প্রশ্নে মা চানভানুর ভেজা চোখে জবাব, ‘বাবা যে ট্যাহা-পয়সা আয় অয়, তা দিয়্যা সংসারই চলে না। হেরপর ঘর বানামু কেব কইরা। টেবিল-চেয়ার কিনমু কী কইর্যা।’
হাসানের বাবা বলেন, ২০০৭ সালে যমুনা নদীতে ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। এরপর থেকে বাঁধের ওপর সরকারি জায়গায় ঘর তুলে বসবাস তাঁদের। ভ্যান চালালেও তাঁর ছেলে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। তাঁরা তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। কষ্ট করে সে আজ ভালো ফল অর্জন করেছে। এখন কোথায় ভর্তি হবে, কীভাবে খরচ জোগাবে—এ চিন্তাতেই তাঁরা দিশেহারা।
হাসান জানায়, ভ্যান চালানো শেষে বাসায় ফিরলে রাত ১২টা পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে সে। বই-খাতা, পোশাক ও অন্যান্য খরচ ভ্যান চালিয়েই জুগিয়েছে। এর সঙ্গে সংসারেও খরচ দিয়েছে। এখন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন তার।
অদম্য মেধাবী চিন্তা খাতুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার আলী নগর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে চিন্তা খাতুন। বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, কঞ্চির বেড়ার ওপর একদিকে খড় ও একদিকে জং ধরা টিনের চালের জীর্ণ একটি ঘর। সেখানেই মা, অসুস্থ বাবাসহ চিন্তার বসবাস। জানা গেল, বৃষ্টির দিনে ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ে। মা গৃহকর্মীর কাজ করে যা পান, তা দিয়ে দুবেলা খাওয়া জোটে। এ ঘরে থেকেই অদম্য মেধাবী হয়েছে চিন্তা। তিন ভাই ও চার বোনের মধ্যে চিন্তাই কেবল এসএসসি পাস করেছে। চিন্তার লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মেনেছেন হতদরিদ্র বাবা-মা। অন্য মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিলেও তাকে বিদ্যালয়ে যেতে দিয়েছেন তাঁরা।
লেখাপড়ার প্রতি চিন্তার এ ভালোবাসার কথা জেনে শিক্ষকেরাই তার পড়ার খরচ ও ফরম পূরণের টাকা জুগিয়েছেন। বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় পরীক্ষার আগে চার্জার লাইটও তাঁরাই দিয়ে এসেছেন। তাঁকে সহায়তা করেছে এক সহপাঠী বান্ধবীও।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দীন বলেন, সে এতটাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান যে, প্রায় দিনই না খেয়ে ক্লাসে আসত। অন্যের সহায়তা ছাড়া চিন্তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু চিন্তার কথা অন্যটা, ‘লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
শোভনের পরিবার-কালো মেঘের মতো দুশ্চিন্তা ভেসে ওঠে : অন্য দিনের মতোই গত ৩০ মেতেও কাকডাকা ভোরে বাবার সঙ্গে প্রতিবেশীর জমির ধান কাটতে গিয়েছিল শোভন কুমার। দিনটি ছিল এসএসসির ফলাফল ঘোষণার।
নাটোরের কালীগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দেওয়া শোভন দুপুরে বাড়ি ফিরে জানতে পারে, জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে সে। অবশ্য এ ফলাফলেও তার বা পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়নি। বরং সবার মনেই যেন তার ভবিষ্যৎ পড়ালেখা নিয়েই কালো মেঘের মতো দুশ্চিন্তা ভেসে ওঠে।
শোভন জানায়, ফলাফল জানার পর বাবা-মা তার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বললেও লুকিয়ে কিছু সময়ের জন্য কেঁদেছেনও। দুশ্চিন্তা করছেন, ভালো ফল করেও সংসারের অনটনের জন্য তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় কি না, সেটা নিয়ে।
মা রুপালী রানী বলেন, ‘ছ্যালিডা খুব কষ্ট করে। লেখাপড়ার ওপর খুব আগ্রহ। একটু সময় আড্ডা দেয় না। বাজে কাজে সময় নষ্ট করে না। রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত পড়ে। আমি পাশে বসে থাকি। তাতেই ও খুশি।’
গাছের নিচে বসে পড়াশোনা মাহফুজার: অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্যেই ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার নগর সাকোয়া গ্রামের মেয়ে মাহফুজা আক্তারের। বাবা দিনমজুর হলেও সাকোয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।
মাহফুজার বাবার মাথা গোঁজার মতো কোনো জমিজমা নেই। সরকারি খাসজমিতে ছোট একটা ঘর তুলে থাকে মাহফুজার পরিবার। বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় ও সঙ্গে কেরোসিন তেলের অভাবে রাতে পড়াশোনা করতে পারেনি মাহফুজা। ছোট অন্ধকার ঘরটিতে পড়তে না পারায় দিনের বেলায় গাছের নিচে বসেই পড়ালেখা করতে হয় তাকে। দুই ভাইবোনের মধ্যে মাহফুজা ছোট। অর্থাভাবে ভাই পড়াশোনা বন্ধ করে এখন দিনমজুরি করে।
টিউশনি করে আর কবুতর পুষে পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে মাহফুজা। ছোটবেলা থেকে প্রতিটি শ্রেণিতে ভালো রেজাল্ট করায় স্কুলের শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে পরীক্ষার ফি ও বইখাতা কিনে দিতেন। মাহফুজার মা হাসিনা বেগম মানুষের বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করে ছেলেমেয়ের জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। এমন দিন গেছে, যেদিন না খেয়েই থাকতে হয়েছে তাদের।
মাহফুজার ইচ্ছা বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। বাবা-মায়েরও ইচ্ছা, সে বড় হয়ে দেশের গরিব-অসহায় মানুষের জন্য কাজ করবে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিতীশ কুমার বলেন, মাহফুজা সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে।