• বৃহস্পতিবার , ২৮ নভেম্বর ২০২৪

ক্ষমতার সম্ভাব্য অপব্যবহারের-মোবাইল ফোনের সিম রেজিস্ট্রেশন-প্রতিকার কি?


প্রকাশিত: ১:২৫ পিএম, ২ এপ্রিল ১৬ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩১০ বার

কামাল আহমেদ :   মোবাইল ফোনের সিম রেজিস্ট্রেশন-ক্ষমতার সম্ভাব্য অপব্যবহারের প্রতিকার Operation ASHAকি? জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে সরকার যে অনেক কিছুই করতে পারে, তা আমরা সবাই জানি। সুতরাং, জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে মোবাইল ফোনের সিম রেজিস্ট্রেশনের একধরনের বাধ্যবাধকতা নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের আদেশের বৈধতা নিয়ে আদালতে একটি রিটও হয়েছে এবং সরকারের প্রতি কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি হয়েছে। কিন্তু যেহেতু আদালত রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করতে বলেননি, তাই সরকারের তরফে কাজটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার একটা চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কোনো কাজ অপরিহার্য হলে সব নাগরিকের জন্যই তাতে সহযোগিতা করার প্রশ্ন আসে এবং সে কারণে আমরাও সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। তবে এই সহযোগিতা নিঃশর্ত হতে পারে না। অনেক ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’র কোনো জবাব না পেলে এই আদেশ পালন করার চেয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারের অভ্যাস ত্যাগ করাই শ্রেয় হতে পারে।
প্রথমত, বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন আসলে কী এবং এর মাধ্যমে কীভাবে সরকার জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করবে, প্রশ্নটি দেখে নেওয়া যাক। বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে গ্রাহকের শুধু নাম-ঠিকানার পরিচয় নথিবদ্ধ করা নয়, তার সঙ্গে আঙুলের ছাপ পর্যন্ত মিলিয়ে নেওয়া। যেহেতু প্রতিটি সিমের বিপরীতে ওই সিমগ্রহীতা গ্রাহকের বায়োমেট্রিক পরিচয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত থাকবে, সেহেতু কোনো সিমের সঙ্গে কোনো অপরাধের যোগসূত্র পাওয়া গেলে ওই অপরাধীকে চিহ্নিত করা সহজ হয়ে যাবে। যুক্তি হিসেবে এটি ভালোই। তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে? নাকি আমরাই প্রথম এ রকম একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করলাম? জঙ্গিবাদী হুমকির বাস্তবতায় এটি নিশ্চয়ই খুব কার্যকর হাতিয়ার?

বিশ্বে জঙ্গিবাদীদের সবচেয়ে বড় এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলা সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো কোথায় ঘটেছে এবং সেসব দেশে কি এ ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে? সন্ত্রাসবাদ যে নতুন বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে, তার সূত্রপাত ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, যা নাইন-ইলেভেন নামে পরিচিত। তারপর থেকে গত ১৫ বছরে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই জঙ্গিবাদীরা আঘাত হেনেছে। লন্ডনে সেভেন সেভেন বা মেট্রোরেলে হামলা, স্পেনে​ মাদ্রিদে রেলে হামলা, প্যারিসে কনসার্ট হলে হামলা এবং সাম্প্রতিক ব্রাসেলসের বিমানবন্দর এবং মেট্রোরেলে হামলা বিশ্বব্যাপী বহুলভাবে আলোচিত। এ ছাড়া ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের মধ্য যুদ্ধপীড়িত রাষ্ট্রগুলোর বাইরে সন্ত্রাস বারবার আঘাত হেনে চলেছে পাকিস্তানে। এসব দেশের কোন কোনটি জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে মোবাইল ফোন গ্রাহকদের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করেছে তা কি আমরা জানি?

ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যাঁরা গেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সাক্ষ্য দিতে পারবেন যে সেসব জায়গায় এ ধরনের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের বালাই নেই। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের প্রায় সব জায়গাতেই মোবাইল ফোনের সেবা পাওয়ার দুটো উপায়। একটি মাসিক চুক্তি আর অন্যটি যতটুকু ব্যবহার ততটুকু ব্যয়। মাসিক চুক্তিতে সেবা নিতে হলে সেবাদাতা কোম্পানির কাছে পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য আবাসিক ঠিকানা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিবরণ দিতে হয়। আবাসিক ঠিকানা প্রমাণের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা পাসপোর্টের কপি কিংবা অন্য কোনো সেবা কোম্পানি যেমন বিদ্যুৎ বা পানির বিল দেখালেও চলে। সেখানে কেউ বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের কথা বলে না। আর যদি পে অ্যাজ ইউ গো নামে পরিচিত যতটুকু ব্যবহার ততটুকু খরচের চুক্তিতে গ্রাহক হন, তাহলে কোনো নাম-পরিচয় প্রমাণের বালাই নেই। চাইলে পরে আমাদের টেলিযোগাযোগ বা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কর্তৃপক্ষের যে কেউ লন্ডনের অভিজ্ঞতা যাচাই করে নিতে পারেন। তাঁরা ওই দেশে আমাদের দূতাবাসগুলোতেও এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। সেখানে বিমানবন্দরে পৌঁছালে লাইকা, লিবরা, সিম্পলকল ইত্যাদি নানা নামের মোবাইল সেবাদানকারী কোম্পানি আপনাকে বিনা পয়সায় সিম অফার করবে। ওই সিমে সৌজন্য হিসেবে নিখরচায় পাঁচ পাউন্ড মূল্যের ফোন করার সুবিধাও থাকে। তারা ওই সিম বিক্রি করে এই আশায় যে এরপর আপনি যতটা সময় (টকটাইম) বা ডেটা কিনবেন, তাতে তাদের খরচ উঠে আসবে। ওই লিবরা ও লাইকা মোবাইলের সিম আমি সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতেও কিনেছি এবং ইউরোপের অন্য কিছু শহরেও তাদের অস্তিত্ব দেখেছি। বার্লিনে ভোডাফোনের পে অ্যাজ ইউ গো সিম পেতেও আমার কোনো রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হয়নি। তাহলে কি আমরা ধরে নেব আমাদের দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি ওই সব পশ্চিমা দেশের চেয়েও বেশি? নাকি তাদের গোয়েন্দা কার্যক্রমের যে দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে, আমাদের তা নেই?

তবে হ্যাঁ, বায়োমেট্রিক আপডেট নামক একটি ওয়েবসাইট জানাচ্ছে চারটি দেশে বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের তথ্য দেওয়া আছে। ওই দেশ চারটি হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। সৌদি আরব, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সন্ত্রাসের ঘটনা যে বন্ধ হয়নি, সে প্রমাণ সাম্প্রতিক বিভিন্ন হামলার সূত্রে আমরা জানি। সুতরাং, বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশন যে ওই দুই দেশে নিরাপত্তা রক্ষায় কাজে এসেছে তা কিন্তু প্রমাণ হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সন্ত্রাসের ঘটনা খুব একটা শোনা না গেলেও সেখানে রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা বজায় রাখার প্রয়োজনে সবকিছুর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমরা কেন সন্ত্রাসপীড়িত আফগানিস্তান-পাকিস্তান অথবা দুই আরব রাজতন্ত্রের নিরাপত্তা কৌশলকে অপরিহার্য ভাবব?

জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি কড়াকড়ি যাকে অনেকে বাড়াবাড়িও বলে থাকেন, সেটা দেখা যায় ভারতে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মুম্বাই ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। মুম্বাইতে ২০০৮ সালে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল এবং তারপর থেকে ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় সেখানকার নিরাপত্তা কড়াকড়ি অনেক বেশি। প্রথম দিন দুপুরে মুম্বাই পৌঁছানোর পর মোবাইল সিম কীভাবে পাওয়া যাবে তা নিয়ে খোঁজখবর করার পর জানা গেল যে পাসপোর্টের কপি জমা দিয়ে তা পাওয়া যাবে। তবে দুটো সমস্যা আছে। প্রথমত, স্থানীয় কোনো ব্যক্তির (হোস্ট) মোবাইল ফোন নম্বর প্রয়োজন হবে, যেটিতে তাঁরা সিম সক্রিয় করার বার্তা পাঠাবেন। আর দ্বিতীয়ত, সিম সক্রিয় হতে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে ট্যাক্সিওয়ালার মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে মাত্র ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই আমার মোবাইল চালু হয়ে গেল। সেখানেও বায়োমেট্রিকের কোনো প্রশ্ন আজ পর্যন্ত ওঠেনি।

ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করা এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার সময় বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষণের একটি জাতীয় ব্যবস্থা এখন দেশে চালু আছে। বলা হচ্ছে, মোবাইল কোম্পানিগুলো গ্রাহকের আঙুলের ছাপ ওই তথ্যভান্ডার থেকে যাচাই করে নেবে। তবে জাতীয় তথ্যভান্ডারে তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কোনো তথ্যভান্ডারে নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও সীমিত প্রবেশাধিকার থেকেও যে তথ্য হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব, সে কথা নিশ্চয়ই আর কাউকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার সিস্টেমে হ্যাকিংয়ের পর নিশ্চয়ই আর কেউ গ্যারান্টি দিতে পারেন না যে আমাদের সব জাতীয় তথ্যভান্ডার অভেদ্য। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারের প্রতি আগ্রহী গোষ্ঠী যে শুধু দেশের ভেতরে আছে তাও নয়। বিদেশের অপরাধী চক্র, রাষ্ট্রীয় অথবা অরাষ্ট্রীয় (স্টেট অ্যান্ড নন-স্টেট অ্যাক্টরস) গোষ্ঠী কাউকেই হিসাবের বাইরে রাখা যায় না।

সরকার মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়ার সময় জনস্বার্থে সরকারি বার্তা প্রচারের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে একটি শর্ত দিয়েছিল এবং এ কারণে মাঝেমধ্যেই সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং দপ্তরের বাণী আমরা আমাদের মোবাইল ফোনে পেয়ে থাকি (যদিও গত দেড় বছরে আমি যতগুলো বার্তা পেয়েছি তার অধিকাংশই হচ্ছে সরকারি প্রচারণা—জনগুরুত্বের নিরিখে খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়)। এগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন নাহয় না-ই করলাম। কিন্তু এখন যে গড়ে দৈনিক গোটা দশেক বার্তা পাই, সেগুলোর সবই আসে বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। নুডলস বিক্রেতা, বলিউড তারকাদের কনসার্ট, হোটেল চেইন, ট্রাভেল কোম্পানি, ব্যাংক, বিমা, ফ্ল্যাট বিক্রেতা—কে নয়? এঁরা সবাই আমাকে গ্রাহক হিসেবে পেতে চান এবং আমার মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠান। আবার দেখা যায় চার ডিজিটের শর্ট কোড ব্যবহারকারী কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে। আপনি হয়তো তখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে আছেন। অথবা বিদেশ থেকে কোনো জরুরি ফোনের অপেক্ষায় আছেন। তখন ওই সব নম্বর থেকে ফোন করে আপনাকে বলা হয় আপনি অমুক শিল্পীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অমুক ডিজিট চাপুন, গান শুনতে চাইলে অমুক ডিজিট…। আমাদের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিংবা টেলিফোন সেবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি বলতে পারবে এসব বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কোন সূত্র থেকে আমার নম্বর হস্তগত করেছে? এদের অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ফোনের যন্ত্রণা থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করার কথা কি তারা আজ পর্যন্ত ভেবেছে? ইউরোপের দেশগুলোতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অযাচিত ফোনকল এবং বার্তা পাঠানোর শাস্তি কতটা কড়া, তঁারা চাইলেই তা খোঁজ নিয়ে জেনে নিতে পারেন।

গ্রাহকদের প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা আছে তাঁর ফোন নম্বর তিনি কাকে দেবেন আর কাকে দেবেন না সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু সেই অধিকার উপেক্ষা করে গ্রাহকদের নম্বরগুলো বাণিজ্যিক বিবেচনায় একের পর এক হাতবদল হয়ে চলেছে। আমার নম্বর গোপন রাখার অধিকার যখন রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারেনি, তখন এই প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয় যে বায়োমেট্রিক তথ্যের গোপনীয়তারও কোনো গ্যারান্টি থাকবে না?

এসব বিতর্কের পর আইনের প্রশ্নটিই বা কীভাবে উপেক্ষা করা যায়? মোবাইল ফোনের সিমের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন কোন আইনের আওতায় হচ্ছে সেই প্রশ্নটি এখন আদালতে বিবেচনাধীন। আইনগত অধিকার, গ্রাহকের অধিকারের সুরক্ষা, ক্ষমতার সম্ভাব্য অপব্যবহারের প্রতিকার ইত্যাদি বিষয়ে আইনগত অবস্থান নির্ধারণ ছাড়া সিম রেজিস্ট্রেশনের জন্য পীড়াপীড়ি না করলেই কি নয়? কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।