কানাডায় বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের শেকড়ের টান
এস রহমান : শেকড়ের টানে কথা বলছে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুরা।দেশে এসে তারা খুজছে স্বজনদের।খুঁজছে ইতিহাস।খুঁজছে শেকড়ের অচেনা মানুষদের। একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মাতৃসম কানাডীয় নাগরিক বনি কাপুচিনোর সঙ্গে আজ শুক্রবার সকালে আলাপচারিতার আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন ’৭১-এর যুদ্ধশিশু শিখার মেয়ে ক্যাটরিনা।
যুদ্ধশিশু শিখা কানাডার উদ্দেশে যখন বাংলাদেশ ছাড়েন তখন বয়স মাত্র চার মাস। অতটুকু বয়সের কোনো স্মৃতি কিংবা উপলব্ধি কারও স্মরণে আসার কথা না, যা তাঁকে আন্দোলিত করতে পারে। সেই শিখাই এ দেশটাকে তিনি তাঁর আত্মায় ধারণ করে আছেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশেই তাঁর শেকড়, এটাই তাঁর স্বপ্ন।
দেশছাড়ার ৪৩ বছর পরে বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে শিখার হয়ে কথাগুলো বলছিলেন তাঁরই মেয়ে ২১ বছরের ক্যাটরিনা।
১৯৭২ সালে কানাডার সমাজকর্মী বনি কাপুচিনো ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন-এর পক্ষ থেকে ঢাকায় এসে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেওয়ার আয়োজন করেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা সে বছরের ১৯ জুলাই ১৫ জন যুদ্ধশিশু নিয়ে কানাডার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এই পথ অনুসরণ করে যুদ্ধশিশুদের কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা শুরু হয়। যুদ্ধশিশুদের প্রথম দলে ছিলেন চার মাসের শিখা, যাঁকে দত্তক নিয়েছিলেন কাপুচিনো দম্পতি। তাঁরা শিখাকে গ্রহণ করেছিলেন নিজ পরিবারের মেয়ে হিসেবে।
একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মাতৃসমা সেই বনির কাপুচিনোর সঙ্গে আজ শুক্রবার এক আলাপচারিতার আয়োজন করেছিল মুক্তিযযুদ্ধ জাদুঘর। সেখানে তাঁরই সঙ্গে হাজির ছিলেন ক্যাটরিনা। ছিলেন বনির ছেলে রবিনহুড কাপুচিনো এবং নাতি কাইনান কাপুচিনো।
আলাপচারিতায় নিজের মা সম্পর্কে ক্যাটরিনা বলেন, ‘আমার মা এ দেশটাকে তার স্বপ্নে এবং আত্মায় লালন করেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি এখানে থাকতে পারেননি। কিন্তু তিনি আমায় বলেছেন, তাঁর শেকড় এখানেই।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে বারকয়েক চোখ মুছলেন ক্যাটরিনা। বললেন, আমি অবশ্যই এখানে শেষবারের মতো আসিনি। চমৎকার এ দেশটাতে আমি আবার আসতে চাই আমার মা এবং বোনসহ।
৮১ বছরের বনি কাপুচিনো বয়সের ভারে এখন অনেকটাই ন্যুজ। কিন্তু মানবতার প্রতি, অখণ্ড মানবাত্মার প্রতি তাঁর ঝোঁক, তাঁর দায়বদ্ধতা এখনো প্রবল। তাঁর নিজের দুই সন্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দত্তক নেওয়া ১৭ জন অনাথ শিশুকে তিনি লালন করেছেন সমান স্নেহে। যার মধ্যে শিখাও একজন। তিনি বলেন, যুদ্ধের অবস্থান সবসময়ই মানবতার বিরুদ্ধে। কেবল অহিংসা এবং ভালোবাসাই পারে এর বিপরীতে শক্তিশালী কিছুকে দাঁড় করাতে।
আলাপচারিতায় বনি ও ক্যাটরিনা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। এর মধ্যে একজন ক্যাটরিনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা তাঁর একটি চিঠি পড়েও শোনান। যুদ্ধাপরাধের বিচারে জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের প্রতি বনির এ অপরিসীম স্নেহ এবং বিশ্ব মানবতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার বিষয়টি বার বার স্মরণ করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন কেউ কেউ।
আলাপচারিতার শুরুতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু মানবতার কোনো সীমা নেই। বনি সেই মানবতাকেই পূজা করেন। এটাই তাঁর ধর্ম।
আলাপচারিতা শেষে বনির ছেলে রবিনহুড কাপুচিনো জাদুঘর প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার বাবা-মা প্রথম যখন সন্তান দত্তক নেন তখন আমার বয়স ১৮ বছর। আমি ভাগ্যবান যে আমি এমন বৃহ ৎ একটা পরিবারে বেড়ে উঠেছি যেখানে আছে প্রেম, সৌহার্দ্যবোধ এবং সুখ-দুঃখ সবকিছু ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা। আমার সবগুলো ভাইবোন বিভিন্ন দেশ এবং আলাদা আলাদা সংস্কৃতি থেকে আসা। আমরা আমাদের পরিবারেও এটার চর্চা করি। কারণ বিষয়টি আমাদেরকে সমৃদ্ধ করে।’
বনি কাপুচিনো আজও দুস্থ শিশুদের পুনর্বাসনে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। চট্টগ্রামে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অনাথ আশ্রম ‘শিশুস্বর্গ’। নেপাল এবং ভারতেও রয়েছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান।