কলির জামানার ভন্ড প্রেমিকের উম্মাদনা-খুন করে শিশু অপহরণ
স্টাফ রিপোর্টার : একেই বলে কলির জামানা! তাইতো এক ভন্ড প্রেমিক ঘটালো উম্মাদনা-! এর জের- খুন করে শিশু অপহরণ করেছে প্রেমিক। প্রেমিকার আবদার, পরিচিত এক নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তান দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এই আবদার মেটাতে সমাজসেবা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন প্রেমিক লিটন কুমার সরকার। কিন্তু এতে ব্যর্থ হন তিনি। পরে মরিয়া হয়ে একটি সন্তান দত্তক দিতে বলেন পূর্বপরিচিত পুষ্প রানি দাসকে। প্রথমে টাকার বিনিময়ে নাতনি মনিশাকে দত্তক দিতে রাজি হন পুষ্প। কিন্তু পরে বেঁকে বসায় তাঁকে খুন করে শিশু মনিশাকে নিয়ে পালিয়ে যান লিটন।
রাজধানীর আবদুল্লাহপুরের একটি আবাসিক হোটেলে পুষ্প রানি দাস হত্যার মূল সন্দেহভাজন লিটন কুমার সরকারকে গ্রেপ্তারের পর আজ বুধবার পুলিশ এসব তথ্য জানিয়েছে। নিখোঁজ দেড় বছরের শিশু মনিশাকেও মাগুরার শ্রীপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, গত সোমবার বেলা তিনটার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনের একটি আবাসিক হোটেল থেকে লিটনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মাগুরার শ্রীপুর থেকে মনিশাকে উদ্ধার করা হয়।
প্রেমিকার সামনে নিজেকে ‘হিরো’ হিসেবে তুলে ধরতেই লিটন পুষ্পকে হত্যা করেন। এরপর শিশু মনিশাকে প্রেমিকার আত্মীয়র হাতে তুলে দেন। আজ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন লিটন। ১৭ এপ্রিল রাতে আবদুল্লাহপুরের নীলা নামে একটি আবাসিক হোটেলে খুন হন পুষ্প।
ওই দিন বিকেলে তিনি লিটন ও তাঁর নাতনি মনিশার সঙ্গে হোটেলটিতে উঠেছিলেন। রাতে লিটন শিশু মনিশাকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। পরে রাত তিনটার দিকে হোটেলের একটি কক্ষে পুষ্পের গলা কাটা লাশ পায় পুলিশ। এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় হত্যা ও অপহরণ মামলা করেন পুষ্পর স্বামী দীনেশ চন্দ্র। থানা-পুলিশের পাশাপাশি ডিবি পুলিশও ঘটনাটির ছায়া তদন্ত শুরু করে। আজ মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার লিটনের বরাত দিয়ে ডিবির কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, লিটনের বাড়ি গাজীপুরের জয়দেবপুরে। তাঁর স্ত্রী ও এক ছেলেসন্তান রয়েছে। মোবাইল ফোনে ঝিনাইদহের শৈলকুপা এলাকার এক কলেজপড়ুয়া ছাত্রীর সঙ্গে লিটনের প্রেমের সম্পর্ক হয়। প্রায়ই প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে শৈলকুপায় যেতেন লিটন।
ওই প্রেমিকা লিটনের স্ত্রী-সন্তানের ব্যাপারে জানতেন না। মাগুরার শ্রীপুরের বাসিন্দা নিঃসন্তান প্রশান্ত কুমার দাস ও পান্না দাস দম্পতি ওই ছাত্রীর আত্মীয়। এই দম্পতিকে একটি সন্তান দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে লিটনকে বলেন ওই ছাত্রী। সে অনুযায়ী লিটন সমাজসেবা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন। সেখানে ব্যর্থ হয়ে পুষ্পর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, লিটনের বাবা পুষ্পকে মেয়ে হিসেবে দেখতেন। অনেক আগে থেকেই দুই পরিবারের সদস্যদের বাসায় তাঁদের যাতায়াত ছিল। পুষ্পর স্বামী বেশ কিছু টাকা ঋণ করেছিলেন। এই ঋণের টাকা তিনি শোধ করতে পারছিলেন না। এই অনটনের সুযোগ নিয়ে পুষ্পকে টাকার বিনিময়ে তাঁর নাতনি মনিশাকে দত্তক দিতে বলেন লিটন।
ডিবি সূত্র বলেছে, গ্রেপ্তার লিটনের ভাষ্য, তিন দফায় তিনি পুষ্পকে ৯০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে প্রশান্ত-পান্না দম্পতির কাছ থেকে লিটন নিয়েছেন ৩০ হাজার টাকা। টাকা পেয়ে পুষ্প নাতনিকে দত্তক দিতে রাজি হন। পুষ্পর কথামতো প্রশান্ত-পান্না দম্পতিকে মাগুরা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসেন লিটন।
তাঁদের শাহবাগের একটি আবাসিক হোটেলে রেখেছিলেন তিনি। ১৭ এপ্রিল দুপুরের পর লিটন, পুষ্প ও শিশু মনিশা বাড্ডার গুদারাঘাটের বাসা (পুষ্পর স্বামীর বাসা) থেকে বের হন। কিন্তু কথা থাকলেও শিশু মনিশাকে লিটনের হাতে তুলে দিতে টালবাহানা করছিলেন পুষ্প।
এ কারণে পুষ্পকে বোঝাতে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁরা আবদুল্লাহপুরের ওই হোটেলে ওঠেন। অনেক বোঝানোর পরও পুষ্প রাজি না হওয়ায় সন্ধ্যা সাতটার দিকে হোটেল কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিচে যান লিটন। এ সময় হোটেলের কর্মচারী শাহ আলমের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। শাহ আলমের কাছে একটি ছুরি চান তিনি।
শাহ আলম কারণ জানতে চাইলে লিটন তাঁকে ২০ হাজার টাকা দেন। টাকা পেয়ে শাহ আলম তাঁকে একটি ছুরি এনে দেন। পরে লিটন হোটেলের কক্ষে ঢুকে দেখেন মনিশা ঘুমাচ্ছে, পুষ্প টেলিভিশন দেখছেন। এ সময় প্রথমে একটি ইটের টুকরা দিয়ে পুষ্পর মাথায় আঘাত করেন। এতে তিনি অচেতন হলে তাঁর গলা কেটে মনিশাকে নিয়ে শাহবাগ এলাকায় চলে যান লিটন।
প্রশান্ত-পান্না দম্পতি ও লিটনের দেওয়া তথ্য অনুসারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, শাহবাগে গিয়ে লিটন মনিশাকে প্রশান্ত-পান্না দম্পতির হাতে তুলে দেন। এরপর সবাই মিলে মাগুরা চলে যান। এরপর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকেন লিটন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত সোমবার তাঁকে কমলাপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মাগুরা যায় গোয়েন্দা পুলিশ। সেখানে প্রশান্ত-পান্নার বাড়ি থেকে মনিশাকে উদ্ধার করা হয়।
জানতে চাইলে ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার তরিকুল ইসলাম বলেন, শিশু মনিশাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলার আরেক আসামি শাহ আলম পলাতক আছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।