• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

‘রাজনীতির নামে’ নাশকতাকারীরা মানুষের ওপর হামলা করছে’


প্রকাশিত: ১০:০০ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৫ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ১৯৪ বার

pppppppp বিশেষ প্রতিবেদক.ঢাকা: ‘রাজনীতির নামে’ নাশকতাকারীরা মানুষের ওপর হামলা করছে ।পুলিশ, হাসপাতাল ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় নিহত ২৪ জনের মধ্যে ১৮ জন শ্রমজীবী মানুষ। এর ১১ জনই পরিবহন শ্রমিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশুও। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘চার থেকে সাড়ে চার শ রোগীর চিকিৎসা দিতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তার মধ্যে নাশকতার রোগীদের নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে।’
বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধের মধ্যে গত ৯ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর মগবাজার আগোরা শপিং মলের সামনে একটি প্রাইভেট কারে পেট্রলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে গাড়ির মধ্যেই দগ্ধ হন চালক আবুল কালাম (২৮)। এরপর তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা জানান, তাঁর শরীরের ৩৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। ছয় দিন অসহ্য যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আবুল কালামের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন তাঁর ভাই মো. ইব্রাহিম। তিনিও পেশায় গাড়িচালক। রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় দুই ভাই একসঙ্গে থাকতেন। কাঁদতে কাঁদতে ইব্রাহিম বলেন, ‘মোরা আর কত মরমু? পেটের টানে জীবন হাতে লইয়া রাস্তায় নামতাছি। মোগোই তারা দেখে? গরিবগো মাইরা তারা কী শান্তি পায়?’ বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার রাংতা গ্রামের মৃত আবুল হকের তিন ছেলের মধ্যে আবুল কালাম ছিলেন সবার ছোট। গতকাল তাঁর লাশ দাফনের জন্য স্বজনরা নিয়ে যায় গ্রামের বাড়ি।

গতকাল পর্যন্ত অবরোধের নৃশংসতায় মারা গেছে ২৪ জন। আহত হয়েছে অনেকে। প্রতিদিন গাড়িতে আগুন, ভাঙচুর, বোমা, পেট্রলবোমা ও হামলার ঘটনা ঘটছেই। এসব নাশকতার শিকার হচ্ছে যারা, তাদের বেশির ভাগই সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চলছে পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্তনাদ।

দগ্ধ রোগী ও নিহতদের স্বজনরা বলছে, তাদের এ পরিণতির জন্য সহিংস রাজনীতি এবং এর সঙ্গে জড়িতরাই দায়ী। যাঁরা পেটের টানে জীবিকার প্রয়োজনে রাজপথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি নাশকতার শিকার হচ্ছেন। পুলিশ, হাসপাতাল ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় নিহত ২৪ জনের মধ্যে ১৮ জন শ্রমজীবী মানুষ। এর ১১ জনই পরিবহন শ্রমিক। নিহতদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশুও।

বার্ন ইউনিটে গিয়ে জানা গেছে, গত ১০ দিনে নাশকতার আগুনে পুড়ে চিকিৎসা নিতে এসেছে ৩১ জন। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছে। এখনো পোড়া ঘায়ের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ১২ জন। চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছে ১৬ জন। দগ্ধ হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পরিবহন শ্রমিক। ঘটনার পর চরম দুর্ভোগে পড়েছে তাদের পরিবার।

পুলিশ, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে দুই শতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। রাজধানীতে পোড়ানো হয়েছে ৭৩টি গাড়ি। সহিংসতার আগুনে দগ্ধ হয়েছে অন্তত ৭০ জন। গুরুতর আহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন শ। গত ৫ জানুয়ারি টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার আগে ৪ জানুয়ারি থেকেই দেশব্যাপী নাশকতা শুরু হয়।

এ পরিস্থিতিতে নাশকতাকারীদের ‘রাজনীতির নামে’ মানুষের ওপর হামলা না চালানোর অনুরোধ জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অবরোধ ডেকে যারা নাশকতা চালাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে হাতজোড় করে বলছি, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কেউ কোনো দিন সফল হতে পারেনি। তাই আপনাদের কাছে মিনতি করছি, আমাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না।’

এদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহিদুল হক বলেছেন, ‘দেশে অবরোধ-হরতালের নামে নাশকতা চালানো হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাতে আক্রান্ত হচ্ছে। আমরা সবার নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। দুষ্কৃতকারীদের ধরতে পুলিশ একা পারবে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। যারা এসব হামলায় জড়িত দুষ্কৃতকারীদের চেনেন তাঁরা আমাদের তথ্য দিন।’

জানা গেছে, ৪ জানুয়ারি নাটোর, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিহত হয় চারজন। ৫ জানুয়ারি একজন নিহত ও অনেকে হতাহত হয়। ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী ও সিরাজগঞ্জে প্রাণ হারায় তিনজন। গত ১০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ট্রাকচালক ইমাদুর রহমান রাজু। ৯ জানুয়ারি রাতে বগুড়ার শিবগঞ্জের মহাস্থানগড়ের ইটভাটার কাছে পিকেটাররা ইমাদুরের ট্রাকে হামলা করে।

১১ জানুয়ারি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় বাস থেকে লাফিয়ে ট্রাকে নিচে পড়ে প্রাণ হারান আসাদুল মিয়া। একই দিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাসের হেলপার মুরাদ মোল্লা। গত ৭ জানুয়ারি ভোরে যশোরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে থামানো বাসে ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হন তিনি। ১২ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আতিকুর রহমান নামের এক ট্রাকের হেলপার।

স্বজনরা জানায়, গত বুধবার নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে অবরোধ সমর্থকরা আতিকুরের ট্রাকে হামলা চালায়। ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে জোরারগঞ্জে ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পুড়ে মারা যান এনাম হোসেন নামের এক দোকান কর্মচারীর। একই দিন নোয়াখালীতে পিকেটারদের হামলায় অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রাণ যায় জমির হোসেন নামে এক চালকের।

মঙ্গলবার রাতে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের বাতাসনগ্রাম এলাকায় ঢাকামুখী একটি যাত্রীবাহী বাসে পিকেটাররা পেট্রলবোমা হামলা চালায়। এতে বাসের মধ্যেই দগ্ধ হয়ে এক শিশুসহ পাঁচজন মারা যায়। দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আরো ১০ জন। গত বুধবার দিবাগত রাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা গেছেন তোফাজ্জল হোসেন নামের এক বাস হেলপার। সর্বশেষ গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেলেন চালক আবুল কালাম।

গত ৭ জানুয়ারি ভোরে যশোরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে থামানো বাসেই ঘুমিয়ে ছিলেন হেলপার মুরাদ মোল্লা। এ সময় দুর্বৃত্তরা সেখানে দুটি বাসে আগুনে দেয়। ঘুমন্ত অবস্থায়ই দগ্ধ হন মুরাদ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে আনা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১১ জানুয়ারি মৃত্যু হয় তাঁর। মুরাদের বাবা তোরাব আলী পেশায় রিকশাচালক। তাঁর বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার মৌশা গ্রামে। তোরাব আলীর তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মুরাদ ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ভাই আব্দুস সামাদও বাসের হেলপার। তিনি গতকাল মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাই পেটের টানে আমরা রাস্তায় না নাইমা পরি না। ভাইডা যহন হাসপাতালে ছিল তখনো আমি কাম করছি। এখন বাড়ির লোকজন কাজে যাইতে দিতে চায় না। কাজ না করলে খামু কী?’

১১ জানুয়ারি রাজধানীর কমলাপুর বাজার রোডের সরদার গার্মেটের সামনে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয় মো. সেলিমের লেগুনায়। এতে সেলিমের শরীরের ৩৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। সংকটাপন্ন এই চালক কেঁদে বলেন, ‘দুই লাখ ট্যাকা ঋণ নিয়া আমি লেগুনাটা কিনছি। প্রতি মাসে আট হাজার ট্যাকা কিস্তি দিতে হয়। এই কারণে গাড়ি নিয়া বাইর হইছিলাম।’ স্বজনরা জানায়, শরীয়তপুরের জাজিরার মৃত ফয়জুল হকের ছেলে সেলিম মা, স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় থাকেন।

৫ জানুয়ারি বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে ময়মনসিংহের অটোরিকশাচালক সিদ্দিকুর রহমানকে। তাঁর শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। দগ্ধ সিদ্দিক বলেন, ‘এই রাজনীতি আমাগো বাঁচতে দেয় না। বিপদ জাইনাও বাইর হইতে হয় পেটের টানে।’

বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন কুমিল্লার লাকসামের কান্দিরপার ট্রাকচালক পিয়ার আহমেদ বলেন, ‘শহরের রাস্তায় আগুন দেয় শুনছিলাম। ভাবছিলাম এইখানে হইব না। আমাগো জন্য কোথাও শান্তি নাই। তারা পারে খালি আমাগো মারতে!’ গত ১০ জানুয়ারি লাকসামের পরানপুরে দুর্বৃত্তরা তাঁর ট্রাকে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পিয়ারের শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

রংপুরের মিঠাপুকুরে যাত্রীবাহী বাসে আগুনের ঘটনায় বুধবার রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান বৃদ্ধা তছিরন বেগম (৬০)। তাঁর স্বামীর নাম জসিম উদ্দিন। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার দক্ষিণ লাখিয়ারপাড়া গ্রামে। ঢাকায় আসার জন্য বুধবার কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে গাড়িতে ওঠেন তিনি। এখন বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন মিঠাপুরের দগ্ধ আরেকজন মিনারা বেগম (২৮)। চিকিৎসকরা জানান, তাঁর শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। মিনারার স্বামী ফজলুল হক জানান, আগুন দেওয়া বাসটিতে মিনারা ও তছিরনসহ ১১ জন আত্মীয় ছিল। তারা একসঙ্গে ঢাকায় আসছিল। তাদের গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জে। গাজীপুরের চৌরাস্তায় তারা থাকে। গার্মেন্টকর্মী ফজলুল হক বলেন, তাঁর স্ত্রী মিনারার ফুফু নিহত তছিরন। কয়েক দিন আগে মিনারার দাদি মারা গেছেন। এ কারণে গাজীপুরে থাকা শ্রমজীবী স্বজনরা গ্রামের বাড়িতে যায়। মঙ্গলবার রাতে তারা একসঙ্গে ফিরছিল। তাদের মধ্যে তিনজন রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছে। বাকি ছয়জন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কিশোর মিনহাজুল ইসলাম অনিক (১৫)। সে এবার ফেনীর সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের এসএসসি পরীক্ষার্থী। গত ৫ জানুয়ারি ফেনী শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় শিক্ষকের কাছে পড়ে হাড্ডাবাড়ী এলাকার বাসায় ফেরার পথে বোমায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বোমার আঘাতে অনিকের বাঁ চোখটি আর স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অনিকের মা জেসমিন রহমান বলেন, ‘আমার ছেলেটার কী হবে জানি না।’