এবার জনমতের কঠিন অগ্নিপরীক্ষা-কে জিতবে?
শফিক রহমান : এবার জনমতের কঠিন অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে। এ পরীক্ষায় পাশ করতে ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন তিন প্রধান দলের তিন নেতা হাসিনা খালেদা এরশাদ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো প্রায় দেড় বছর বাকি থাকলেও বড় দলগুলো ইতিমধ্যে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়ে জনমত নিজেদের পক্ষে নিতে লড়ছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে ফের নৌকায় ভোট চাইছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করতে গিয়ে তিনি বেশ সাড়াও পাচ্ছেন। জনগন দেশের উন্নয়নে এখনও সরকারের পক্ষে আছে এটা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।কিন্তু সমস্যা সরকার দলীয় সংগঠন সমূহের অভ্যন্তরীন কোন্দল।
যেটা ইতিমধ্যে কুমিল্লা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছে? এ প্রশ্ন আওয়ামী লীগকে তাড়িয়ে বেড়াবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। এক্ষেত্রে একটি কথা বেশ স্পষ্ঠ হয়ে উঠেছে শেখ হাসিনার উপদেষ্ঠা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথায়। তিনি ইতিপূর্বে অনেকবার বলেছেন, ঐক্যবদ্ধ থাকলে আওয়ামী লীগকে কেউ কখনো হারাতে পারবে না। এটাই বাস্তব এবং ধ্রব সত্য!
দেশের রাজনীতির মাঠ প্রত্যক্ষ করে দেখা গেছে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি ইতিমধ্যে নেয়া শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই প্রধান দুই দল নির্বাচনী মাঠে ইতিমধ্যে দলীয় কোন্দল সামাল দিচ্ছেন। তবে অনেকের মতে, বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগে কোন্দল বেশী। এ পরিস্থিতিতে যে দল ঐক্যবদ্ধ থাকবে তাঁদেরই পক্ষে যাবে জনমত!
সরেজমিনে দেখা গেছে, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে- এমনটা ধরে নিয়েই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এখন থেকেই মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে চাইছেন।
কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন কিনা, এ নিয়ে রয়েছে সংশয়। কয়েক বছর ধরেই মাঠ পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে দলটির সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠ ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অপরদিকে নির্বাচনের আগে মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে বিএনপিতেও নানা সংশয় আছে। এক্ষেত্রে ভোটের আগে নির্বাচনী মাঠ যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ফল তাদের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ মাঠের পরিস্থিতি ভোটে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অতীতে এমনটাই ঘটেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, তা খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়েছে। জানিয়েছেন, আগামীতে তিনি অংশগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চান। দলটির নীতিনির্ধারকরাও তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে সেরকম বার্তাই দিচ্ছেন।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে দলটি যে স্বস্তিতে রয়েছে, তেমনটা এখন নেই। তাই ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন আগামীতে হবে না। এটা এখন স্পষ্ঠ। মুখে যাই বলুক তলে তলে বিএনপি ঘর গুছিয়ে নিচ্ছে।কুসিক নির্বাচন সেটাই প্রমাণ করে। ওই নির্বাচনে দেখা গেছে, বিএনপির লোকজন নৌকার ব্যাজ পরে ধানের শীষে ভোট দিয়ে সাক্কুকে জিতিয়েছে। কাজেই আগামী নির্বাচন সহজে পার পাওয়া যাবেনা।
অন্যদিকে এবার চাইলেও একতরফা নির্বাচন করার সুযোগও নেই। কারণ শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবেই। এছাড়া কারণ যাই হোক না কেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য এখন থেকে দেশি-বিদেশি নানা চাপও ভেতরে ভেতরে অব্যাহত আছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর অনেকেই মনে করছেন, ২০১৪ সালের মতো আগামী নির্বাচনে প্রভাবশালী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো কোনো দলের পক্ষে প্রকাশ্যে কোনো সমর্থন নাও জানাতে পারে। সে কারণে সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনে করছে, একটি তমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সবার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই ভোটের হিসাব করতে গিয়ে এখন হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের সঙ্গে আপস করতেও দ্বিধা করছে না সরকারি দল।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সব পক্ষকে আস্থায় এনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এক ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে একাধিক বক্তব্যে বলেছেন, আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আবুল মকসুদ বলেন, টানা ২ মেয়াদে সরকারে থাকলে যে কোনো দলের অবস্থান শক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড এবং দলটির নেতাদের আচরণ বলে দিচ্ছে, তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। তাদের চিরাচরিত সমর্থকদের ওপরও আস্থা রাখতে পারছেন না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বেতন বাড়িয়ে এবং ঘন ঘন অন্যায্য পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনও হাতে রাখতে চাইছে।
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগ দলের অভ্যন্তরের সমস্যা দূর করাসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধী শক্তির সঙ্গেও আপস করছে। কিন্তু মূল সমস্যার সমাধানের দিকে যাচ্ছে না। আসল সমস্যা হল ফায়দার রাজনীতি, আইনের শাসনের অভাব এবং দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন। সুবিধার জন্য দলীয় লোকজনরা একে অপরের বিরুদ্ধে লাগছে, অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়কারীদের বিচার না হওয়ায় অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছে। এভাবে পরিস্থিতি খারাপ দিকে গড়াচ্ছে।
অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড, নেতাদের বক্তব্য স্পষ্ট করে তুলছে যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আর সরকার বিএনপিকে সে নির্বাচনে চাইছে। কিন্তু কথা হল, আওয়ামী লীগ যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। আর সেজন্য চরম বিপক্ষের শক্তির সঙ্গেও হাত মেলাচ্ছে, প্রশাসনকে হাতে রাখার মেকানিজমও করছে। এসবের মাধ্যমে আগে যেমন মনে করা হতো, সহজেই আগামী নির্বাচনে জিততে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ, সেই ধারণায় চিড় ধরছে। আর যত দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। বিএনপি মাঠে নামছে। এ দলটির রিজার্ভ ভোটও আছে। তা ছাড়া সরকারবিরোধী সেন্টিমেন্ট জনগণের মধ্যে প্রবল।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। শেখ হাসিনা কোনো অন্যায়ের কাছে আপস করেননি, দুর্র্নীতি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এ দেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে, আগামী নির্বাচনে তারা নৌকাকেই ভোট দেবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ইতিমধ্যে জাতিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন উপহার দিয়েছে, আগামীতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনও উপহারও দেবে। আমরা আশা করি, বিএনপি সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা দেবে।
তবে দেশের বুদ্ধিজীবীরা বলেন, সারা দেশে একশ্রেণীর নেতাকর্মীদের বেপরোয়া চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও ক্ষমতা অপব্যবহারে সাধারণ ভোটাররা ক্ষুব্ধ। তবে বিলম্বে হলেও বিষয়টি সরকার দলীয় হাইকমান্ডও বুঝতে পেরেছে। তাই এখন থেকে নেতাদের লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। বিতর্কিত এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নেতাদের ডেকে কঠোর হুশিয়ারি দেয়া হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানোর চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে মহিউদ্দিন ও নাসিরের মিলন সেটা প্রমাণ করছে যে, কোন্দল করা চলবে না-একযোগে কাজ করতে হবে।
ওদিকে বিএনপিও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। সরকারবিরোধী কয়েক দফা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে সাংগঠনিকভাবে দলটি কাহিল। মামলা-হামলায় নেতাকর্মীরা এখনও অনেকে এলাকা ছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী মাঠ তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে দলটির ব্যাপক জনসমর্থনকে বাড়তি সুবিধা হিসেবে দেখছেন অনেকেই।
আগামী নির্বাচনে নিজ দলের ভোটার সমর্থক ছাড়াও সরকারবিরোধী বড় একটি অংশের সমর্থন তারা পাবে। এ পরিস্থিতিতে বর্তমানে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদী কর্মকর্তারা রাতারাতি ভোল পাল্টাতে পারেন। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে বিএনপি ।