এনআইডি স্মার্ট কার্ডে চোখের মনি বলে দেবে আপনি কে?
আসমা খন্দকার : জাতীয় পরিচয়পত্রের স্মার্ট কাার্ডে চোখের মনি বলে দেবে আপনি কে? এনআইডির তথ্যভাণ্ডারে নাগরিকদের হাতের বৃদ্ধাঙুল ও তর্জনির ছাপ রয়েছে। ২০০৮ সালে এই ছাপ সংগ্রহে অনেক ত্রুটি ছিল। এছাড়া বয়স বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আঙুলের ছাপে পরিবর্তন হতে পারে। এমনটা চিন্তা করে ইসি নতুন করে দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ চোখের মণির (আইরিশ) ছবি সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডির উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট কার্ড বিতরণ ২ অক্টোবর শুরু হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি এক বা একাধিক জেলার কার্ড বিতরণ করা হবে। পর্যায়ক্রমে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সব ভোটারকেই স্মাট কার্ড দেওয়া হবে। তবে এই স্মার্ট কার্ড নেওয়ার সময় নাগরিকদের পুরনো কার্ড জমা দেওয়ার পাশাপাশি ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছবি দিতে হবে। এক্ষেত্রে কারও কার্ড হারিয়ে গেলে প্রথমে পুরনো কার্ডটি তুলে তা জমা দিয়ে স্মার্ট কাড নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ কার্ড বিতরণের উদ্বোধন করবেন। এর পরদিন থেকে রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে কার্ড বিতরণ শুরু হবে। তবে সব ওয়ার্ড থেকে এক যোগে বিতরণ হবে না, পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্মার্ট কার্ড নেওয়ার সময় ভোটারদের নতুন করে কোনও ছবি তুলতে হবে না বা কোনও তথ্য দিতে হবে না। নির্বাচন কমিশনে প্রত্যেক ভোটারের যে ছবি ও অন্যান্য তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে, তারই ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে স্মার্ট কার্ড। অর্থাৎ ভোটারদের হাতে বর্তমানে যে লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে, তার ছবি ও অন্যান্য তথ্যযুক্ত থাকবে নতুন স্মার্ট কার্ডে। তবে, কোনও ভোটার স্মার্ট কার্ড তৈরি হওয়ার আগে ছবি পরিবর্তন বা অন্যান্য তথ্য সংশোধন করে থাকলে স্মার্ট কার্ডে নতুন ছবি পাবেন।
এদিকে স্মার্ট কার্ড পাওয়ার পরও ভোটারদের ছবি বা অন্যান্য তথ্য সংশোধন/হালনাগাদের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ// ফি জমা দিয়ে তাদের নিজ নিজ নির্বাচন অফিসে আবেদন করতে হবে। সংশোধিত নতুন স্মার্টকার্ড তৈরি হলে ভোটারের মোবাইলে এসএমএস’র মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। পরে তারা উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়ে তা সংগ্রহ করবেন।
স্মার্ট কার্ড কোন প্রক্রিয়ায় বিতরণ করা হবে, জানতে চাইলে আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মিহির সারওয়ার মোর্শেদ জাতিরকন্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা এখনও কোনও নির্দেশনা পাইনি। তবে জেনেছি ঢাকা শহরে ওয়ার্ড ভিত্তিক কার্ড দেওয়া হবে। এখনও তো হাতে এক মাসের মতো সময় রয়েছে। এর আগে নিশ্চয়ই আমরা বিষয়টি পুরোপুরি জানতে পারব।’
কার্ড বিতরণের প্রক্রিয়ার বিষয়ে কমিশনের মাঠ প্রশাসনেও এখনও কোনও নির্দেশনা যায়নি বলে জানান বগুড়া জেলা নির্বাচন অফিসার ইউনুচ আলী। তিনি বলেন, ‘কবে থেকে এবং কিভাবে কার্ড বিরতণ করা হবে, সে বিষয়ে আমাদের প্রতি কোনও নির্দেশনা এখনও আসেনি।
২০০৮ সালে যখন ছবিযুক্ত ভোটার কার্ড প্রথম বিতরণ করা হয়, তখন ওয়ার্ড ও ইউনিয়নভিত্তিক হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তথ্য সংগ্রহকারীদের মাধ্যমে কার্ড বিতরণ করা হয়। এবার যেহেতু কার্ড নেওয়ার সময় ভোটারদের আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছবি দিতে হবে, সেহেতু নির্দিষ্ট কোথাও ক্যাম্প করে এটা দিতে হবে।’
ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিতরণ
নির্বাচন কমিশন ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে স্ব-স্ব ওয়ার্ডের ভোটারদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ওয়ার্ডের নির্দিষ্ট কোনও স্থানে ক্যাম্প করে কমিশনের প্রতিনিধিরা ভোটারদের ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছবি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে স্মার্ট কার্ড নেবেন। আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছবি সংশ্লিষ্ট ভোটারের তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে স্মার্ট কার্ড নিতে হলে ভোটারকে অবশ্যই নির্ধারিত ক্যাম্পে যেতে হবে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ওয়ার্ড থেকে কার্ড বিতরণ করা হলেও সব ওয়ার্ড থেকে একযোগে কার্ড দেওয়া হবে না, পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। কার্ড বিতরণের আগে মাইকিংসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ভোটারদের জানানো হবে বলে কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মতো অন্যান্য সিটিকরপোরেশন এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক ক্যাম্প করে কার্ড বিতরণ হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম জানান, রাজধানীতে স্মার্ট কার্ড বিতরণের জন্য আমাদের ৭৫টি টিম রয়েছে। আর রাজধানীতে রয়েছে ১৫টি থানা অফিস। প্রত্যেক থানার একটি করে ওয়ার্ড বেছে নিয়ে এক বা একাধিক দিনে আমাদের টিমগুলো কার্ড সরবরাহ করবে।
পৌরসভা ও ইউনিয়ন কার্যালয়ে কার্ড
সিটি করপোরেশন ছাড়া দেশের অন্যান্য এলাকায় পৌরসভা কার্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভোটারদের মাঝে কার্ড দেওয়া হবে বলে ইসি সচিব জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পৌরসভা কার্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদে ক্যাম্প করে ওই এলাকার ভোটারদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। তবে, কোন পৌরসভার আয়তন বড় হলে আমরা একাধিক স্থানে কার্ড বিতরণের ক্যাম্প করার পরিকল্পনা করেছি। প্রয়োজন হলে ইউনিয়নের ক্ষেত্রে একাধিক ক্যাম্প করা হতে পারে।
পুরনো কার্ড জমা না দিয়ে নতুন কার্ড নয়
প্রত্যেক ভোটারকে স্মার্ট কার্ড নেওয়ার সময় তাদের কাছে থাকা কার্ডটি জমা দিতে হবে। পুরনো কার্ড না দিয়ে নতুন কার্ড পাওয়া যাবে না। কারও কার্ড হারিয়ে গেলে কেবল পুলিশি ডায়রির কপি বা অন্য কোনও অঙ্গীকারনামা দিলেও হবে না। এক্ষেত্রে জিডি করে ভোটারকে ইসির নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আগে পুরনো কার্ড তুলতে হবে। এরপর সেই কার্ড জমা দিয়ে স্মার্ট কার্ড নিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘কারও কার্ড হারিয়ে গেলে বা বিনষ্ট হলে সেই ভোটারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার সুযোগ নেই। নতুন কার্ড নিতে হলেও বর্তমান কার্ড ফেরত দিতে হবে। কার্ড হারিয়ে গেলে যেহেতু ফি দিয়ে তা তোলার বিধান রয়েছে, সেহেতু জিডির কপি নিয়ে কার্ড দিলে সেটা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
এজন্য কারও কার্ড হারিয়ে গেলে আগে পুরনো কার্ড তুলে সেটা জমা দিয়ে নতুনটা নিতে হবে।বর্তমানে প্রায় ৯ কোটি ভোটারে কাছে বিদ্যমান লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।
নতুন ভোটাররা পাবেন জমা স্লিপে স্মাট কার্ড
গত ২০১৪ ও ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশন ভোটার হালনাগাদ করলেও এই দু্ই বছরে যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের এখনও কোনও কার্ড সরবরাহ করা হয়নি। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এসব ভোটারের মাঝে একবারে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের পরিকল্পনা থেকেই কমিশন বর্তমানে বিদ্যমান সাধারণ মানের লেমিনেটেড কার্ড তাদের দেয়নি।
গত ২০১৪ সালে ৪৬ লাখ ৯৫ হাজার ৬৫০ এবং ২০১৫ সালে ৪৪ লাখ ৩২ হাজার ৯২৭ জন নতুন ভোটার হয়েছেন। এসব নতুন ভোটার ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সময় যে জমা স্লিপ পেয়েছেন, তা জমা দিয়ে স্মার্ট কার্ড নেবেন। তবে, জরুরি প্রয়োজনে এসব নতুন ভোটারের মধ্য থেকে কেউ লেমিনেটেড জাতীয় পরিচত্রপত্র নিয়ে থাকলে স্মার্ট কার্ড নেওয়ার সময় সেই কার্ড ফেরত দিতে হবে।
এ বিষয়ে ইসি সচিব জানান, ‘২০১৪ সালের পর যারা ভোটার হয়েছেন, কমিশন তাদের এখনও কোনও ধরনের কার্ড দেয়নি। ফলে তাদের আমরা সরাসরি স্মার্ট কার্ড দেব। এক্ষেত্রে তাদের স্লিপ বা প্রমাণ নিয়ে আসতে হবে।’
কেন ১০ আঙুল ও চোখের মণির ছবি
এনআইডির তথ্যভাণ্ডারে নাগরিকদের হাতের বৃদ্ধাঙুল ও তর্জনির ছাপ রয়েছে। ২০০৮ সালে এই ছাপ সংগ্রহে অনেক ত্রুটি ছিল। এছাড়া বয়স বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে আঙুলের ছাপে পরিবর্তন হতে পারে। এমনটা চিন্তা করে ইসি নতুন করে দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ চোখের মণির (আইরিশ) ছবি সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের মণির ছবি সংগ্রহ সম্পর্কে বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবেও এটির চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া বেশি বয়সী নাগরিকদের অনেকের বৃদ্ধাঙুল ও তর্জনির ছাপ স্পষ্ট নয়। এ কারণে ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০-এ বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়ের জন্য একজন নাগরিকের বায়োমেট্রিক ফিচার যথা আঙুলের ছাপ, হাতের ছাপ, তালুর ছাপ, আইরিশ বা চোখের কণিকা, মুখাবয়ব, ডিএনএ, স্বাক্ষর ও কণ্ঠস্বর সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এ কাজের অনেকটাই বাকি রয়ে গেছে।
গত বছর অক্টোবর থেকে আমেরিকা থেকে কেনা ১০টি মেশিনে এনআইডি’র স্মার্টকার্ড তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রতিমাসে ৫০ লাখ কার্ড তৈরির ক্ষমতা রয়েছে এসব মেশিনের। প্রতি ঘণ্টায় একটি মেশিনে ৯৫০টি কার্ড উত্পাদন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর অধিকাংশ কার্ড তৈরি শেষ হয়েছে। পাশাপাশি ২০১৪-১৫ সালে হালনাগাদে যারা ভোটার হয়েছেন, তাদের কার্ড তৈরি সম্পন্ন হয়েছে।