• রোববার , ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এক নিমিষের নাই ভরসা-দাবার বোর্ডেই জিয়া না ফেরার দেশে


প্রকাশিত: ১:০২ এএম, ৬ জুলাই ২৪ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭২ বার

 

স্পোর্টস রিপোর্টার : এক নিমিষের নাই ভরসা- বন্ধ হইবে রঙ তামাশা চক্ষু মুদিলে –হায়রে দম ফুরাইলে।। রঙিন রঙিন দালান কোটা দামী দামী গাড়ি…আজ বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের ১২তম রাউন্ড চলছিল। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। প্রতিপক্ষ গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের বিপক্ষে ভালো পজিশনেই ছিলেন জিয়া। কিন্তু ম্যাচ চলাকালীন হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ৫০ বছর বয়সী এই গ্র্যান্ডমাস্টার।বিকেল ৩টায় শুরু হওয়া ম্যাচটি চলতে চলতে ৫টা ৫২ মিনিটে হঠাৎ লুটিয়ে পড়েন জিয়াউর। এরপর অনাকাঙ্ক্ষিত সেই খবর শুনেই সবাই দ্রুত ছুটে যান দাবা বোর্ডের রুমে। তড়িঘড়ি করে তাঁকে ধরে নিচে নামানো হয়। জিএম রাজীবের গাড়িতে করে শাহবাগের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় জিয়াকে। মিনিট দশেকের মধ্যেই হাসপাতালে পৌঁছে যায় গাড়ি।

হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা দ্রুতই তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। তবে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চেষ্টা করেও চিকিৎসকেরা তাঁর পালস খুঁজে পাননি। কিছুক্ষণ পরই খবর আসে, জিয়া আর নেই। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে আনার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন জিয়া।গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক মাস্টার (আইএম) খেতাব পান জিয়া। ২০০২ সালে অর্জন করেন গ্র্যান্ডমাস্টার (জিএম) খেতাব। বিগত ২০২১ সালে তিনি ৭.৫/৯ স্কোর নিয়ে ঢাকায় মুজিববর্ষ আমন্ত্রণপত্র জিতেছিলেন।

৪৪তম দাবা অলিম্পিয়াডে ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়ার সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ২০২২ সালে তাঁরাই বনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পিতা-পুত্র জুটি, যাঁরা জাতীয় দাবা দলে ছিলেন।জাতীয় দাবার ১২তম রাউন্ড চলছে। গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদকে ফিদে মাস্টার মনন রেজা নীড় হারালে, আর দুই গ্র্যান্ডমাস্টার রাজীব-জিয়ার লড়াইয়ে জিয়া হারলে ১৪ বছর বয়সী নীড় জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হবেন। এই সমীকরণ মাথায় নিয়ে বিকেলের দিকে দাবা ফেডারেশনে উপস্থিত সবাই।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তৃতীয় তলায় ক্রীড়া রুমে খেলা চলছিল। খেলা চলাকালে অন্যদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ। ফেডারেশনের প্রশাসনিক কক্ষে অথবা সাধারণ সম্পাদকের রুমে দাবার আড্ডাই ভালোই জমে। প্রশাসনিক কক্ষে ঢুঁ দিয়ে দেখা গেল জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা, ফাহাদের বাবা, আন্তর্জাতিক বিচারক হারুনুর রশিদ, ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক মাসুদুর রহমান মল্লিক আড্ডারত। এক যুগেরও বেশি সময় ক্রীড়া সাংবাদকিতা করায় এদের সবার সঙ্গেই সখ্যতা।

আড্ডায় শামিল হওয়ার পর জানা গেল নীড় নিয়াজের সঙ্গে ড্র করেছেন, আর জিয়া-রাজীব লড়াই চলছে। আগামীকাল (শনিবার) শেষ রাউন্ডে অমিত বিক্রমকে হারালেই চ্যাম্পিয়ন নীড়। ঠিক এমনি মূহুর্তে আচমকা খবর খেলতে ওেখলতে জিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন। জাতীয় দাবার অন্য প্রতিযোগিরা জিয়ার মাথা ও পা ধরে আছেন। কেউ পানি ছেটালেন। কয়েক মিনিট পর একটু দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আবার নীরব-নিস্তব্ধ। অ্যাম্বুলেন্সে কথা বলছিলেন ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ। উপস্থিত অনেকে বললেন, ‘অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে, রাজীবের (আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার) গাড়িতে দ্রুত উঠানো হোক।

কালক্ষেপণ না করেই ফেডারেশনের তিনতলা থেকে সিড়ি দিয়ে নামিয়ে রাজীবের গাড়িতে তোলা হয় তাকে। সেই মুহূর্তে এসে উপস্থিত হন ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক শোয়েব রিয়াজ আলম। রাজীবের গাড়ি কোথায় যাবে এ নিয়ে দুই-এক মিনিট আলোচনা। কেউ বললেন, ‘কাকরাইলে ইসলামী হাসপাতাল নিকটবর্তী সেখানে নেওয়া হোক’ আবার কেউ বললেন, ‘হৃদযন্ত্রের সমস্যা বোধহয়, শুক্রবার রাস্তা ফাঁকা ইব্রাহিম কার্ডিয়াকেই নেওয়া হোক।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যে ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। রাজীবের গাড়িতে আন্তর্জাতিক বিচারক ও ফেডারেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুন ছিলেন। জিয়ার স্ত্রী মিনিট দুয়েক পর রওনা হন শোয়েব রিয়াজ আলমের গাড়িতে। আমরা পৌঁছানোর পরপরই দেখি জিয়ার স্ত্রী ইব্রাহিম কার্ডিয়াকের জরুরি বিভাগের সামনে কাঁদছেন, ‘আমার জিয়াকে ডাকো, জিয়া ঘুমিয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল তাকে ধরে বোঝাচ্ছেন। আমরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জরুরি বিভাগে ঢুঁ দিয়ে জানলাম পালস পাচ্ছেন না চিকিৎসকরা।

রোগীর পালস পাওয়ার জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করেন। জিয়ার জন্য অপেক্ষা বিশ মিনিটেরও বেশি। এরপরও পালস ও প্রেশার কিছুই আসছে না। চিকিৎসকরা নিশ্চিত জিয়া আর নেই। তার স্ত্রী মানতে নারাজ জিয়া, ‘এভাবে যেতে পারে না।’ অন্য হাসপাতালে নিতে চান জিয়াকে। ফেডারেশনের আরও কর্মকর্তা, দাবাড়ু ও জিয়ার পরিবারের অন্য সদস্যরাও ততক্ষণে এসে উপস্থিত।

চিকিৎসকের সঙ্গে সবাই আলাপ করে বুঝলেন জিয়া আসলেই আর নেই! স্ত্রী লাবণ্য মানতে রাজি নন। জিয়ার ছেলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়া স্কুলপড়ুয়া। তিনি কাঁদলেও মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পরিবারের অন্যরা সবাই মেনে নেওয়ার পর সাড়ে ৬টার দিকে হাসপাতাল আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুর পত্র লেখে। ৭টার একটু আগে দেওয়া হয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণা।চোখের পলকেই জিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন।আকস্মিকভাবে সকল কিছুর উর্ধ্বে গেলেন জিয়া।