এক্স স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের হাজার কোটি ঘুষ বাণিজ্য ফাঁস
এরা এসপি পোস্টিং ২ কোটি, এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ এক কোটি টাকা,ওসি বদলি ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিতো। আর এভাবে হাজার কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন কামাল-হারুন চক্র।
লাবণ্য চৌধুরী : ঘুষের বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এই সাম্রাজ্যের হাত এত লম্বা ছিল যে, ঘুষ-চাঁদা না দিলেই পড়তে হতো কোপানলে।এই চক্রের সদস্যরা হলেন- যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন। এরা এসপি পোস্টিং ২ কোটি, এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ এক কোটি টাকা,ওসি বদলি ২৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা নিতো। আর এভাবে হাজার কোটি টাকা ঘুষ বাণিজ্য করেছেন কামাল-হারুন চক্র।
পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস থেকে আদায় করা হতো ঘুষের অর্থ। বস্তায় ভরে নেয়া হতো টাকা। আর ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষেরা পড়তেন চাঁদাবাজির কবলে। ঘুষ-চাঁদাবাজির অর্থ নিরাপদে রাখতে পাচার করে দেয়া হতো দেশের বাইরে।কিন্তু সাম্রাজ্যের পতনের পরই কামালের ঘুষ কারবারের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এরি মধ্যে ঘুষ গ্রহণ ও অর্থপাচারের অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালসহ তার দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের কাছে এরি মধ্যে কামালের অভিযোগের পাহাড় জমেছে। অনুসন্ধানের জন্য কমিশনের উপপরিচালক মো: জাহাঙ্গীর আলম এর নেতৃত্বে টিম গঠন করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসাদুজ্জামান কামাল ঘুষ-চাঁদাবাজির জন্য তখনকার অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্রের সদস্যরা হলেন- যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।
টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনিই। আর ওইসব অর্থ নিরাপদে রাখতে পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে। টাকা দেশের বাইরে পাচারের ব্যবস্থা করতেন কামালের ব্যাবসায়িক পার্টনার এস আলম গ্রুপের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এই চক্র জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিতো। তাদের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পেতেন না। জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ঘুষ আদায় করা হতো এক থেকে তিন কোটি টাকা।
বিভিন্ন প্রমাণ ঘেটে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে মোল্ল্যা নজরুলকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে পাঁচ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্ল্যা নজরুল। গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদের কাছ থেকে পাঁচ কোটি টাকার চেক ফেরত নেন। এর বদলে তিনি নগদ টাকা দুই কোটি আর বাকি তিন কোটি টাকার আরেকটি চেক দেন। আর লেনদেনের এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেওয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের তেজগাঁওয়ের মনিপুরী পাড়া এলাকার বাসায়।
কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ছিল আরেকটি চক্র। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বও হয়েছে বিভিন্ন সময়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বদলি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন জ্যোতি। কামাল তাকে জানান, হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলতে। এ নিয়ে গত জুন মাসে বাসায় কলহ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ব্যাপক-ভাঙচুর করেন জ্যোতি।
এদিকে এনজিওর ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতে গিয়ে প্রতি সংস্থা থেকে ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা চাঁদা দিতে হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের দরবারে। ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে। তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেয় সেই এনজিও। মনিপুরী পাড়ায় কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেওয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে কোনো সার্কুলার হলেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি তালিকা পাঠানো হতো। সেই অনুযাী নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক এই মন্ত্রী। ২০২৩ সালে দুই অক্টোবর ৫৩৫ জনকে জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এরমধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার ও ৮৪ জন গাড়িচালক। নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। সাবেক এই মন্ত্রীর নির্দেশে সেই তালিকা মোতাবেক নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। সেই নিয়োগে জনপ্রতি আট থেকে ১২ লাখ টাকা নেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।