• রোববার , ১৭ নভেম্বর ২০২৪

ইলিশ-পান্তা কৃষক ও আদি বাঙ্গালির চরিত্রের সাথে প্রহসন!


প্রকাশিত: ৪:৪৪ পিএম, ১৩ এপ্রিল ১৭ , বৃহস্পতিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩১৮ বার

ইকতেদার আহমেদ  :  বঙ্গাব্দের সূচনা বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জোরালো মত 1st boisjak-www.jatirkhantha.com.bdহলো মোঘল সম্রাট আকবরের সময় প্রচলিত হিজরী চন্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।  সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞার্নী আমির ফতুল্লাহ সিরাজীকে হিজরী চন্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন।

ফতুল্লাহ সিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। মূল হিজরি পঞ্জিকা চন্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। সৌর বৎসর ৩৬৫দিন এবং চন্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন হওয়ার কারণে সৌর বৎসরের চেয়ে চন্দ্র বৎসর ১১ দিন কম হয়। তৎকালীন বাংলায় কর আদায় সহজ করার জন্য মূলত: বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রচলন হয়।

চন্দ্র বর্ষপঞ্জি বাংলা তথা ভারতে চাষাবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। অসময়ে কর দেয়ার কারণে দরিদ্র কৃষকদের জীবন দূবিসহ হয়ে উঠেছিল। প্রাথমিকভাবে বঙ্গাব্দের মাসগুলো নেয়া হয়েছিল সংস্কৃত থেকে এবং সে অনুযায়ী নামকরণ করা হয় ‘ফসলী সন’। পরবর্তীতে এর নাম হয় বঙ্গাব্দ। সম্রাট আকবর তাঁর সিংহাসনে আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন।

এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। অনেকের মতে রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪খ্রিস্টাব্দে বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন।

যেকোন জাতির খাদ্যাভ্যাস তার সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। বাঙ্গালিদের বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙ্গালি। এর অর্থ বাঙ্গালির প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। বাংলাদেশের সর্বত্র যেমন ধান উৎপন্ন হয় অনুরূপ দেশের সর্বত্র বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এ সকল প্রজাতির একটি হলো ইলিশ। ইলিশ একটি সামুদ্রিক মাছ এবং এটি প্রজননের সময় মিঠা পানিতে এসে ডিম ছাড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছর প্রজনন করে থাকলেও সবচেয়ে বেশি প্রজনন করে বাংলা আশ্বিন মাসের শেষ সপ্তাহ হতে কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহ অবধি।

আমাদের মৎস্য চাহিদার প্রায় ১২% মিটানো হয় ইলিশ মাছ হতে। আমাদের দেশে সাধারণত বর্ষাকালে নদ-নদীতে ইলিশ মাছের বিচরণ দেখা যায়। আর এ কারণে সে সময়ই সর্বার্ধিক সংখ্যক ইলিশ ধরা পড়ে। বর্তমানে সমুদ্র হতে যান্ত্রিক ট্রলারের মাধ্যমে মাছ আহরণের কারণে সারা বছরই সামুদ্রিক ইলিশ পাওয়া যায়; তবে এগুলো বর্ষাকালে নদ-নদীতে প্রাপ্ত ইলিশের চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির হয়ে থাকে।

বাংলার কৃষক আবহমান কাল হতে সকালের আহারে বিশেষত: গ্রীষ্মকালে যে খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত তা হলো পান্তা ভাত। সাধারণত রাতে খাবার গ্রহণের পর যে ভাত অবশিষ্ট থাকে তা সকাল অবধি খাওয়ার উপযোগী রাখার জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পান্তা ভাতের সাথে কৃষকরা সাধারণত রাতে খাওয়া পরবর্তী যে সব তরকারি অবশিষ্ট থাকে তা অথবা লবণ, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, শুটকি বা নারিকেল বা মরিচ বা আলু ভর্তা, পেয়াজ প্রভৃতি খেয়ে থাকে। গ্রীষ্মকাল ব্যতীত বছরের অপরাপর সময় রাতে আহার পরবর্তী যে ভাত অবশিষ্ট থাকে তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা না থাকায় পানি দেয়া আবশ্যক হয় না।

এ ভাত কৃষকরা উপরোল্লিখিত তরকারি বা ভর্তা বা লবণ, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, পেয়াজ প্রভৃতি দিয়ে খেয়ে থাকে। কৃষকদের গ্রীষ্মকালে মাঠে কাজ করার সময় শরীর হতে প্রচুর পরিমানে ঘাম নির্গত হওয়ার কারণে লবণ ও পানির অভাব দেখা দেয়। প্রাচীনকাল হতে কৃষকরা পানি মিশ্রিত পান্তা ভাত লবণ দিয়ে আহার করে ক্ষুধা নিবারণসহ শরীরের লবণ ও পানির অভাব পূরণ করে আসছে।

গ্রামাঞ্চলে অতীতে কৃষকদের মধ্যে যে দারিদ্রতা ছিল বর্তমানে তার অনেকটাই লাঘব হয়েছে। বর্তমানে গ্রামের অধিকাংশ কৃষকের বাড়ী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসার কারণে এবং অনেকের বাড়ীতে ফ্রিজের সংস্থান হওয়ায় এখন আর আগেকার মতো আহার পরবর্তী যে খাবার অবশিষ্ট থাকে তা ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখার কারণে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

তাছাড়া বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চাষাবাদে ব্যাপকভাবে কলের লাঙ্গলের প্রচলন হওয়ায় জমি চাষে অতীতের ন্যায় হালের ব্যবহার একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। কলের লাঙ্গলের চাষে কৃষকের পরিশ্রম না হওয়ার কারণে শরীর হতে ঘাম নির্গত না হওয়ায়  লবণ ও পানির অভাব ঘটার উপক্রম হয় না। আর তাই আগেকার মতো এখন কৃষকের পান্তা ভাত খাওয়ারও অবকাশ ঘটে না।

আমাদের দেশের কৃষক কখনো ভাতের সাথে ইলিশ মাছকে তাদের প্রধান খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেনি। কৃষকের ভাতের সাথে ইলিশ মাছ খাওয়াটা অনেকটা এর প্রাপ্যতা ও তাদের সামর্থের ওপর নির্ভর করে। অতীতে যেমন কৃষক মাটির শানকিতে ভাত খেতো এখন খুব কম কৃষকই পাওয়া যায় যারা মাটির শানকিতে ভাত খাওয়ার অভ্যাস আঁকড়ে ধরে আছে। কৃষকের মাটির শানকিতে ভাত খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগের মূল যে কারণ তা হলো তাদের আর্থিক অসচ্ছলতার অবসান।

আমাদের দেশ অতীতে যতটা না কৃষি নির্ভর ছিল বর্তমানে তা ক্রমহ্রাসমান। এরপরও দেশের এক ব্যাপক জনগোষ্ঠি এখনো কৃষি কাজকেই জীবীকার বাহন হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। আমাদের কৃষকের যে খাদ্যাভ্যাস তা-ই বাঙ্গালির খাদ্যাভ্যাস। আমাদের দেশের জনমানুষের বাংলায় বসবাস এবং বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণেই তাঁরা বাঙ্গালি।

বর্তমানে বাঙ্গালি জাতি মুসলিম ও হিন্দু দু’টি পৃথক ধর্মাবলম্বী হলেও উভয়ের অতীত মাছে-ভাতে বাঙ্গালি হতে বিচ্যুত নয়। সম্রাট আকবরের বাংলা এখন বিভাজিত হয়ে এর একটি অংশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গ তথা বাংলা রাজ্য এবং অপরটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। উভয় বাংলার জনমানুষ পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালন করলেও অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতায় বাংলাদেশ পশ্চিম বঙ্গ তথা বাংলা রাজ্য হতে এগিয়ে রয়েছে।

আমাদের দেশের শহুরে জনমানুষের একটি অংশের মধ্যে দেখা যায় পহেলা বৈশাখ এলেই দিনটি উদযাপনের জন্য তারা মাটির শানকিতে পান্তা ভাত ও ইলিশসহ বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে দিনের আহারের সূচনা করে কৃষকের সাথে একাত্ব হওয়ার প্রয়াস নিয়ে নিজেকে বাঙ্গালির আদিরূপে খুজে পাওয়ার বাসনায় নিমগ্ন হন।

বছরের একটি দিন মাটির শানকিতে ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া কৃষক ও বাঙ্গালির সংস্কৃতি নয় এবং কৃষক ও আদি বাঙ্গালিরা কখনো উপলক্ষ্য করে অতীতে মাটির শানকিতে ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খায়নি। আর তাই একটি বিশেষ দিনে শহরের এক শ্রেণীর জনমানুষের পহেলা বৈশাখকে উপলক্ষ্য করে ইলিশ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়া কৃষক ও আদি বাঙ্গালির চরিত্রের সাথে প্রহসন বৈ আর কিছু নয়। সুতরাং এটিকে সংস্কৃতি হিসেবে আঁকড়ে ধরে অপসংস্কৃতিকে সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিজেদের ঐতিহ্য, স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তার বিসর্জন। লেখক-সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।