• সোমবার , ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন ‘৩২ নম্বর পোড়াবাড়ি’


প্রকাশিত: ৯:৫৮ পিএম, ৬ আগস্ট ২৪ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৭১ বার

প্রিয়া রহমান : বাড়ির নিচতলায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। লাশ পড়ে আছে সামনে, আগুনে পোড়ার ক্ষত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি, মেঝেতে ছাইয়ের স্তূপ। অনেকে বাড়ির বিভিন্ন দেয়ালে কয়লা দিয়ে ‘লেখা ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন ৩২ নম্বর পোড়াবাড়ি’ সহ বিভিন্ন কথা লিখে রেখেছে। বাড়ির ওপরের তলায় চালানো হয় ভাঙচুর। ধ্বংস করা হয় স্মৃতিস্মারক।আগুনে অবশিষ্ট নেই কিছু। এই সিঁড়িতে হত্যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। কাচের বাক্সে সংরক্ষিত জামাকাপড় পড়ে আছে মেঝেতে। আধা পোড়া কয়েকটি ছবির ক্যানভাস। পড়ে আছে স্মৃতিস্মারক একটি জুতা। পুড়ে শেষ লোহার আলমারি। বাড়িটি ঘিরে মানুষের ভিড়। বাড়ির নিচতলায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। মঙ্গলবার ৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

দেখা গেছে, অজ্ঞাত পরিচয় দুটি লাশ পড়ে ছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে। পুরোনো ছাপা ছিটকাপড় দিয়ে ঢাকা লাশ দুটি ঘিরে বেশ কিছু কৌতূহলী মানুষ। পাশেই ধানমন্ডি লেকের কিনার ঘেঁষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও পুষ্পস্তবক রাখার বিধ্বস্ত বেদি। সড়কের অপর পাশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ির ভাঙা ফটক দিয়ে প্রবেশ করছে শত শত মানুষ। আগুনে পুড়ে গেছে তিনতলা বাড়িটি।

অথচ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক বাড়ির রয়েছে নিবিড় সংযোগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই বাসভবন থেকে মুক্তিযুদ্ধের আগের দিনগুলোতে দিকনির্দেশনা দিতেন। হাজার হাজার মুক্তিপাগল মানুষ আসত তাঁর মুখ থেকে আন্দোলনের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে আসতো এই বাড়িতে। কিন্তু বিধির কি বিধান সেই বাড়িটিই আজ ৩২ নম্বর পোড়াবাড়িতে পরিণত হলো।

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল এই বাড়িতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী–পুত্র, পুত্রবধূসহ আত্মীয়দের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এখানে। ৪৯ বছর পর সেই একই আগস্ট মাসে আবার এক নির্মমতা–কবলিত হলো বাড়িটি। গতকাল সোমবার বিকেলে বিক্ষুব্ধ মানুষ এই বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে।

বঙ্গবন্ধুর এই বাড়িটিকে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। মূল বাড়িটি তিনতলা। হত্যাকাণ্ডের সময় যে অবস্থা ছিল, যত দূর সম্ভব অবিকল সেই অবস্থায় বাড়ি, আসবাব, গুলি চিহ্নিত দেয়ালগুলো, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র সব সংরক্ষণ করে বাড়িটিকে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। পরে মূল বাড়ির পেছনে একটি নতুন ভবন করে সেখানে পাঠাগার, গবেষণা কেন্দ্র ও সেমিনার কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল।

সরেজমিনে দেখা গেল দলে দলে মানুষ বাড়িটি দেখতে আসছে। মূল বাড়ির তিনতলা পর্যন্ত প্রতিটি ঘরের দরজা–কপাট পুড়ে গেছে। নিচের ও দোতলার প্রতিটি ঘরের সব জিনিসপত্র পুড়ে মেঝেতে ছাই-কয়লার স্তূপ হয়ে আছে। সিলিং ফ্যানের পাখাগুলো দুমড়েমুচড়ে গেছে আগুনের তাপে। দেয়ালগুলো কালো হয়ে আছে ধোঁয়া ও কালিতে। তৃতীয় তলার ঘরে আগুনের ক্ষতি কম। তবে জিনিসপত্র যা ছিল সেগুলো লুট হয়ে গেছে।

মূল বাড়ির পাশে ছিল রান্নাঘর, দুটো আলাদা ছোট ঘর কবুতরের জন্য। এগুলোর শুধু পোড়া কাঠামো রয়েছে। পেছনের নতুন ভবনের নিচতলায় পড়ে ছিল সাদা সিমেন্টে তৈরি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। এই ভবনের পাঠাগার থেকে লোকজন বই ও অন্যান্য দ্রব্যাদি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। সেখানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষার্থী লুটপাট ঠেকানোর চেষ্টা করছিলেন। বিশেষ করে বইগুলো নিয়ে তাঁরা মেঝের পাশে জমা করছিলেন।

তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চূড়ান্ত পর্বের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলাম ও স্ট্যান্ডার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানভী আহমেদ বললেন, তাঁরা লুটপাট বন্ধের চেষ্টা করছেন। বইগুলো রক্ষা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বইগুলো কাদের হেফাজতে দেবেন, তা নিয়ে বেশ সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছিলেন।

বাড়িটি দেখতে আসা নানা মানুষের নানা মত। জুরাইন থেকে এসেছিলেন ব্যবসায়ী শাহ আলম। তিনি বলেন, যেভাবে লুটপাট হচ্ছে এটা খুবই দুঃখজনক। এমনটা হওয়া উচিত নয়। কলাবাগান থেকে আসা মশিউর রহমানের বক্তব্য, মানুষের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। লুটপাট, দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের ওপর দমনপীড়ন তারাও কম চালায়নি। এমন পরিণতি তো হওয়ারই কথা ছিল। মানুষের ক্ষোভের আগুনে পুড়ে যাওয়া এই ভবনটি ইতিহাসের আরেক দফা পালাবদলের সাক্ষী হয়েই থাকবে।