আমান গয়েশ্বরকে সরকারি সমাদর- প্রধানমন্ত্রীর মানবিকতা বিএনপিতে অস্বস্তি!
শফিক রহমান : বিএনপির আহত দুই নেতাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিকতায় বিএনপিতে নানা অস্বস্তি চলছে। চলছে নানা আলোচনার ঝড়! আমান ও গয়েশ্বরকে নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে সরকার ও বিএনপির মধ্যে। শনিবার সংঘর্ষের সময় তারা আহত হন।
তারা হাসপাতালে ভর্তির পর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমান উল্লাহ আমানকে খাবার ও ফলমূল পাঠানো হয় এবং পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হবার পর ডিবি অফিসে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ‘আপ্যায়ন’ করার ঘটনাটি শুধু দলের মধ্যেই নয়, সারাদেশই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধির হাসপাতালে গিয়ে মি. আমানের সাথে কথা বলার ভিডিও এবং ডিবি অফিসে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মধ্যাহ্ন ভোজের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে।
বাংলাদেশে বিরোধী দল বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি চলাকালে আহত হওয়া দুই নেতা- স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং ঢাকা মহানগর উত্তরের আহবায়ক আমান উল্লাহ আমানকে নিয়ে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে দলটির ভেতরে ও বাহিরে। ঘটনার পর পরই আওয়ামী লীগের সমর্থকরা দুটি বিষয়কেই ‘প্রধানমন্ত্রীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির’ বহি:প্রকাশ দাবি করে ভিডিও দুটি ব্যাপক শেয়ার করতে থাকেন।
অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থকরা এ ধরণের ভিডিও প্রকাশ ও প্রচার করার তীব্র সমালোচনা করেছেন। দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সাথে সরকার, প্রশাসন বা পুলিশের এমন আচরণের নজির প্রায় নেই বললেই চলে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিকতার বিশ্ব স্বীকৃত। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের
বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তিনি মাদার অব হিউম্যানিটি খেতাব ও অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর তাদের গুলশানের বাসভবনে গিয়েছিলেন সমবেদনা জানাতে। কিন্তু বিএনপি নেতারা ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গেটের ভিতরেই ঢুকতে দেয়নি। কাজেই শেখ হাসিনা রাজনীতি যাই করুক মানবিকতায় তিনি সদা বলিয়ান থাকেন।
যাহোক, বিএনপি সমর্থকদের অনেকে দাবি করেছেন যে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতেই ‘সরকার পরিকল্পিতভাবে এটা করেছে। আবার, অনেকের কথায় ঘটনাটি নিয়ে অস্বস্তিও প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও ঘটনা দুটি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে।যদিও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমান উল্লাহ আমান দুজনেই পরে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে নিজেদের বক্তব্য দিয়েছেন।
মি. গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অভিযোগ করেছেন যে ডিবি অফিসে নেয়ার আগে ধোলাইখালে পুলিশ তাকে বেধড়ক পিটিয়েছে। অন্যদিকে, আমান উল্লাহ আমান বলেছেন তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় সরকার একটি নাটক সাজিয়েছে, যা ঘটেছিল শনিবার।
শনিবার অবস্থান কর্মসূচির সময় মি. রায় ধোলাইখালে অবস্থান করছিলেন।সে সময়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায় সেখানে তিনি একদল কর্মীকে নিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেন।এ সময় দলীয় কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা পরস্পরকে লক্ষ্য করে ইটের টুকরো ছুঁড়ছিল এবং এক পর্যায়ে ইটের আঘাতে মি. রায়ের মাথা রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। পরে পুলিশ সদস্যরা তাদের ঘিরে ধরে বেধড়ক পিটায়।মি. রায় যখন রাস্তায় পড়ে যান তখনো একজন পুলিশ সদস্যকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতে দেখা গেছে।পুলিশ মি. রায়কে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডিবি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি ডিবি প্রধানের সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নিয়েছেন এমন ছবি ছড়িয়ে পড়ে পরে।
এরপর পুলিশই তাকে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে রেখে আসে।সেখানে মি. রায় অভিযোগ করেন যে তাকে কোমর থেকে নীচের দিকে বেধড়ক পিটিয়েছে সরকার।
অন্যদিকে, আমান উল্লাহ আমান ছিলেন গাবতলী এলাকায়। পুলিশ তাকে আটক করার সময় তিনি রাস্তায় পড়ে যান।সেখান থেকে গাড়ীতে তুলে পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেই হাসপাতালে ফুল ও খাবার নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি। ওই সময়ের একটি ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধির সঙ্গে মি. আমানকে কথাও বলতে দেখা যায়। পরে সেই হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার সময় ওই ঘটনাকে সরকারের নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করে মি. আমান।
দুটি ঘটনাই মূহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যাতে অস্বস্তিতে পড়ে যান বিএনপির অনেকে। যদিও কিছুক্ষণের মধ্যে বিএনপি সমর্থকরা দুই নেতার সমর্থনে ও ঘটনাটি নিয়ে সরকারকে সমালোচনা করে বক্তব্য বা পোস্ট দিতে শুরু করেন।তবে ঘটনাটি নিয়ে নানা মুখী আলোচনার জের ধরে প্রশ্নের মুখে পড়েন বিএনপির শীর্ষ নেতারাও।
শনিবারই বিকেলে দলের সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই নেতার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেন।মি. আলমগীর বলেন নিজেদের রক্ষার জন্য ও নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণের জন্য সরকার এই ধরণের নাটক সাজিয়েছে। আগেও অনেককে আটক করেছে। নির্যাতন করেছে ডিবি অফিসে নিয়ে। প্রায় ৪৫০ জন নেতাকে আটক করেছে। তখন তাদের সুস্বাদু আম খাওয়ানো হয়নি। এখন খাওয়ানো হচ্ছে ভিসানীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
অর্থাৎ বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে সেটিই বিএনপির দুই নেতাকে সমাদর করার কারণ হিসেবে দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব। অনেক দিন ধরেই সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি।
দলের অন্য নেতারাও বলছেন যে তারা মনে করেন অসুস্থ দুই নেতাকে ‘ফুল আর খাবার দিয়ে গোপনে ভিডিও করে তা প্রচার’ করা হয়েছে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, এটা ঠিক হয়তো অনেকের মধ্যে সাময়িক অস্বস্তি তৈরি হয়েছিলো তখন। কিন্তু এখন সবাই বুঝতে পারছে দুই নেতাকে হেয় আর দলে বিভ্রান্তি তৈরি করতেই সরকার এসব নাটক করছে।তার মতে সরকার ‘যে হীণ উদ্দেশ্যে’ এটা করেছে সেটা তো গোপন ভিডিও করা থেকেই পরিষ্কার।
মেরে আহত করে আবার তাদের সামনে খাবার দিয়ে গোপনে ভিডিও করা হলো। ডিবি অফিসে তো বাইরের লোক ভিডিও করেনি। আবার সেগুলো প্রচার করলো কারা। তাও সরকার। তাই এতে বিএনপির মধ্যে বিভ্রান্তির কিছু নেই। সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বুঝতে পারছে ক্ষমতায় টিকে থাকতে যে কোনো অপরাধ ও অনৈতিক কাজই এ সরকার করতে পারে।
তবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ডিবি অফিসে নেয়ার বিষয়ে ডিবি প্রধান হারুণ অর রশীদ বলেছেন ধোলাইখালে মি. রায় রাস্তায় পড়ে গেলে পুলিশ তাকে গাড়িতে করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসে। আমরা তাকে সেভ করেছি, সাংবাদিকদের বলছিলেন তিনি। ঘটনা দুটি নিয়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকজন বিএনপি নেতার সাথে কথা বলা হলে তারা ঘটনাটিকে ভালভাবে নেননি।একজন বলেছেন উভয় নেতাই ঘটনার শিকার, তবে তারা গণমাধ্যমের কাছে আরও স্পষ্ট করে কথা বললে হয়তো কোনো অস্বস্তিই তৈরি হতো না।
দুই নেতাই দলের ত্যাগী ও পুরনো নেতা। তাদের নিয়ে অস্বস্তির সুযোগ নেই। তবে পুলিশ ও সরকার যে কোনো হীন কাজ করতে পারে চরিত্রহননের জন্য এটা তাদের বোঝা দরকার ছিলো, বলছিলেন ঢাকায় দলটির মধ্যম পর্যায়ের একজন নেতা। ঢাকার বাইরে থেকে শনিবারের মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসা উত্তরাঞ্চলের কয়েক নেতা বলেন, পুলিশ ও সরকারি দলের নেতাদের সাথে বিএনপি নেতাদের খাওয়ার টেবিলে বসাই ঠিক হয়নি। কারণ যে কোনো ভাবেই হোক তারা বিএনপির মধ্যে সংকট তৈরি করতে চায়।তবে নেতাকর্মীদের অভিমত যাই হোক সিনিয়র নেতারা বলছেন দলের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি নেই। কারণ তারা মনে করেন ভিডিওতেই পরিষ্কার হয়েছে যে পরিস্থিতির ওপর দুই নেতার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা প্রকাশের পরিস্থিতিই সেখানে ছিলো না বলেও দাবি করেন তারা।