• বুধবার , ২৭ নভেম্বর ২০২৪

আবাসিকে বাণিজ্যিক ! রাজউকে গন্ডগোল-ঢাকায় নানা দুর্ভোগের শংকা


প্রকাশিত: ১২:৩৬ এএম, ২৭ আগস্ট ২৩ , রোববার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৪৩ বার

বিশেষ প্রতিনিধি : আবাসিকে বাণিজ্যিক করণ নিয়ে রাজউকে গন্ডগোল-অবস্থা চলছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগীরা।বলা হয়েছে, ঢাকার ১০০ ফুট সড়কের দুইপাশে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

কিন্তু এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে কোনো সমীক্ষাই করা হয়নি। এদিকে নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাসিক এলাকার নির্ধারিত প্লটে ঢালাওভাবে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ রাখলে যাতায়াত ও পরিবহনের চাপ আরও বাড়বে। স্থায়ী বাণিজ্যিক স্থাপনার পাশাপাশি সড়কের দুইপাশে অস্থায়ীভাবে কাঁচামাল, নিত্যপণ্য, শাকসবজি ইত্যাদি কেনাবেচার কার্যক্রমও ব্যাপকতা পেতে পারে। ফলে যানজট ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হবে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ঢাকার মূল সমস্যা জনঘনত্ব ও ঢাকামুখী মানুষের স্রোত। তাই নগরীর সমস্যা সমাধানে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত কমানোর ওপর জোর দিতে হবে। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের এক বক্তব্যেও অভিন্ন ধারণার প্রকাশ ঘটেছে। গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ঢাকায় কত মানুষ বসবাস করবে, তারও একটা সীমা ঠিক করতে হবে। এ নিয়ে নীতিমালা করার সময় এসেছে।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিগত সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনেকেই বেশি লাভের আশায় নির্দিষ্ট ফি দিয়ে আবাসিক প্লটবাণিজ্যিকে রূপান্তর করার সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবেন। এর ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বটে, কিন্তু সেই সূত্রে গ্রাম ও মফস্বল থেকে রাজধানীমুখী মানুষের স্রোতও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) গত বছর সংশোধিত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রকাশ করেছে। সেখানে ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ভবনের উচ্চতা কমিয়ে দিয়েছে। এলাকাভিত্তিক গণপরিসর বিবেচনায় ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ সেই সংস্থার মাধ্যমেই আবার জনঘনত্ব বাড়াতে সহায়তা করবে এমন নতুন নীতিমালা করা হয়েছে; এটা স্ববিরোধী অবস্থান। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ঢাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে চারগুণ বেশি মানুষের বসবাস। আর নাগরিক সুবিধা রয়েছে প্রয়োজনের মাত্র এক- তৃতীয়াংশ। রয়েছে ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বেশি গণপরিবহন। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটলে রাজধানীর অবস্থা আরও শোচনীয় হবে।

২২ শর্ত ও বিষয় নিয়ে নতুন নীতিমালা গত ৩ মে রাজউকের আওতাধীন গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা অনুমোদন করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই নীতিমালা অনুযায়ী, ১০০ ফুট প্রশস্ত সড়কের দুইপাশের আবাসিক প্লটে শর্তসাপেক্ষে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলার অনুমোদন দেওয়া হবে।

রাজউকের জন্য প্রণীত নতুন নীতিমালায় ২২টি শর্ত ও বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এই নীতিমালা প্রণয়নকাজে নেতৃত্ব দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সহযোগিতা দিয়েছে রাজউক। এরপরও কোনো সমীক্ষা ছাড়াই নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা।

নীতিমালা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আবাসিক এলাকার ১০০ ফুট সড়কের দুইপাশের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পর্কে বলা হয়েছে- গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান অ্যাভিনিউ, বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, রবীন্দ্র সরণি, সোনারগাঁ জনপদ, গাওসুল আজম অ্যাভিনিউ, গরীবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ, শাহ মখদুম অ্যাভিনিউ, শাহজালাল অ্যাভিনিউ, ঈশা খাঁ অ্যাভিনিউ ও আলাওল অ্যাভিনিউ এ কার্যক্রমের আওতায় পড়বে। রাজউকের আওতাধীন অন্যান্য যেসব এলাকায় ১০০ ফুট সড়ক থাকবে, সেখানেও এই বিধান প্রযোজ্য হবে। বেসরকারি হাউজিং প্রকল্পও এ সুযোগে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটাতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ আরও বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ দাবি তুলে আসছি। এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকায় আরও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানানো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। রাজউক সঠিক পথে চলছে না। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে এসব এলাকার আবাসিক পরিবেশ নষ্ট হবে। যানজট, জনজট ও জনদুর্ভোগ বাড়বে।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এই নীতিমালা রাজউকের সংশোধিত ড্যাপের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা সেখানে জনঘনত্ব কমাতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আবার এদিকে ঢালাও বাণিজ্যিকের অনুমোদন দেওয়ার নীতিমালা অনুমোদন করেছে। এমন স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো তা চিন্তাও করতে পারি না। ‘

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঢালাওভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। এজন্য প্রয়োজন ওসব এলাকায় বিস্তারিত সমীক্ষা করা। এরপর সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সেসব এলাকায় সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারত। কিন্তু তা না করে ঢালাওভাবে নেওয়া এ সিদ্ধান্ত দুঃখজনক’। তিনি বলেন, ‘ঢালাওভাবে আবাসিক এলাকার নির্ধারিত সড়কগুলোয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিলে ঢাকার ওপর চাপ বাড়বে। ওইসব এলাকার বাসযোগ্যতার মানও কমে যাবে।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্তারিত সমীক্ষা করে এমন সিদ্ধান্ত নিলে সেটা ভালো হতো; তবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত নির্দেশনায় বিস্তারিত সমীক্ষা করতে রাজউককে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজউকের পরিকল্পনা শাখা সেই কাজ শুরু করেছে। ‘

রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেই আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো নীতিমালা না থাকায় ৬০ ফুট ও ৮০ ফুট সড়কের পাশেও অনেক বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার আবেদন জমা পড়েছে। এ নীতিমালার মাধ্যমে এতদিনের বিশৃঙ্খল অবস্থাকে কিছুটা শৃঙ্খলায় আনা হচ্ছে। তবে এর মাধ্যমে প্লটমালিকরা যাতে উৎসাহী না হন, সেজন্য প্লটের শ্রেণি পরিবর্তনের ফি দ্বিগুণ করা হয়েছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘আগে থেকেই এসব আবাসিক এলাকার কিছু সড়কে বাণিজ্যিক অনুমোদন দেওয়া ছিল। কোনো নীতিমালা না থাকায় সেসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এজন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো; যাতে রাজউক শৃঙ্খলভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। ‘ তিনি বলেন, ‘সার্বিক দিক বুঝে রাজউককে আবাসিক প্লটের শ্রেণি পরিবর্তন করতে বলা হয়েছে। তারা প্রয়োজনে বিস্তারিত সমীক্ষা করে এসব কাজ করবে।