আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে ও বন্ধুদের ধর্ষণকান্ডে রাজধানী তোলপাড়
এস রহমান : আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে ও ছেলের বন্ধুদের ধর্ষণকান্ডে রাজধানীতে তোলপাড় অবস্থা চলছে। পুলিশ জানায়, একটি চার তারকা হোটেলে দেহরক্ষীর পাহারায় ধর্ষণ করেছে লম্পটরা। খোদ রাজধানীর বনানী অভিজাত এলাকায় এমন ঘটনায় বিস্মিত নগরবাসি। জানা গেছে, বন্ধু সাদনান সাকিফের প্ররোচনায় জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে দেহরক্ষীধারী ধর্ষকদের হাতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণী ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় সারাদেশে যখন তুমুল আলোচনার ঝড় চলেছে তখনি বের হয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
ধর্ষণ কাণ্ডের পর দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীর অভিযোগ নিতে থানা-পুলিশের সময় লেগেছে ‘৪৮ ঘণ্টা’ চেষ্টা। কারণ প্রধান অভিযুক্তের বাবা যে দেশের অন্যতম স্বর্ণ ব্যবসায়ী। অন্যদের বাবারাও অনেক ক্ষমতাশীল। স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ক্ষমতার সংযুক্তিতে ২৫ লাখ টাকা ‘ঘুষ’ নিয়েও শেষ পর্যন্ত বনানী থানা পুলিশ মামলা নিতে বাধ্য হয়েছে। যার মামলা নম্বর আট। এর মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত সাফাত আহমেদ আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে। বাকি দু’জনের মধ্যে একজন প্রভাবশালী এক নেতার ছেলে, অন্য জনের পরিচয় জানা যায়নি। সাফাতের ড্রাইভার বিল্লাল ও দেহরক্ষীকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।শনিবার রাতে এ মামলা করেন ধর্ষিত এক তরুণী আর এখন দুই তরুণীর কাছে এটাই বড় সান্ত্বনা!
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২৮ মার্চ বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে গিয়ে তারা ধর্ষণের শিকার হন। সাফাত আহমেদ ও নাঈম আশরাফ নামে দু’জন তাদের সারা রাত হোটেলের দুটি কক্ষে অস্ত্রের মুখে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। সেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছে ধর্ষকরা। এখন ওই ভিডিও প্রকাশসহ তাদের খুন ও গুম করার হুমকি দিচ্ছে।
এই ঘটনা ঘটেছে মাস খানেকেরও বেশি আগে। আর এ নিয়ে মামলা হয়েছে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায়!তবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ধর্ষণের শিকার এক শিক্ষার্থী। তিনি বলেছেন, লোকলজ্জার ভয়ে তাঁরা বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আসামির তরফে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল, আসামির দেহরক্ষী তাঁকে নিয়মিত অনুসরণ করতে থাকেন এবং দুজনের বাসায় গিয়ে খোঁজখবর নেন। এমনকি ধর্ষণের ভিডিও আপলোড কারার হুমকিও দেওয়া হয়।
জানা গেছে, মামলা নিয়ে গত দু’দিন ধরে নাটক চলেছে। ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানী থানায় এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ দেন। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ অভিযোগ নিতে গড়িমসি করে। অনেক অনুনয়-বিনয় করার পর অভিযোগ নিলেও পুলিশ মামলা নেয়নি। তার পরও চেষ্টা চালিয়ে যান ধর্ষিত দুই তরুণী। ৪৮ ঘণ্টার চেষ্টার পর সফল হন তারা। তার পরও ভোগান্তি পিছু ছাড়েনি তাদের- স্বাস্থ্য পরীক্ষার নাম করে মামলার বাদীকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে আসামিদের রক্ষার জন্য পুলিশকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু পুলিশ বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
তবে পুলিশের দাবি, বাদীকে আটকানো হয়নি। রবিবার তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হবে। তাই তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী কমিশনার রফিকুল ইসলাম জানান, ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়ার পর তা নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করা হয়। এজন্য দু’দিন সময় লেগে যায়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরই শনিবার রাতে মামলা নেয়া হয়। তিনি বলেন, ঘটনার দিন তারা দ্য রেইনট্রি হোটেলে অবস্থান করছিলেন এর সত্যতা পাওয়া গেছে। বিষয়টি আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বাদীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা গেলেও এর পর থেকে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি।
ধর্ষিত দুই তরুণীর অভিযোগ, ২৮ মার্চ সাফাতের জন্মদিন ছিল। সাদনান তাদের বারবার ফোন করে বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যায়। অনুষ্ঠান শেষে গভীর রাতে সাদনান তাদের ফেলে চলে আসে। পরে সাফাত ও নাঈম তাদের হোটেলের দুটি কক্ষে আটকে রেখে ধর্ষণ করে। সেই ঘটনার ভিডিও করে সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল।
দুই তরুণী বলেন, অভিযুক্ত তিন তরুণের পরিবার খুবই প্রভাবশালী। অভিযোগ দেয়ার পর নানাভাবে তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে। তারা এখন চরম উৎকণ্ঠায় আছেন। সাফাত ও নাঈম বিভিন্ন লোক দিয়ে তাদের অনুসরণ করছে বলেও তারা দাবি করেন।
এক তরুণী বলেন, তারা বুঝতেই পারেননি সাদনান তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করবে। সাদনান তাদের বন্ধু। সাফাত এবং নাঈমের সঙ্গে সাদনানের মাধ্যমেই তাদের পরিচয় হয়। ঘটনার দিন বারবার ফোন করে তাদের রেইনট্রিতে নেয়া হয়। রাত ২টা পর্যন্ত সাদনান তাদের সঙ্গে ছিল। পরে সে (সাদনান) তাদের সেখানে রেখে চলে আসে। আগে থেকেই ওই হোটেলে দুটি কক্ষ বুক করে রেখেছিল সাফাত ও নাঈম। দুই তরুণীকে সেখানে রাতভর আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা হয়। এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়। পরদিন সকালে দু’জনকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই তরুণী বলেন, সাদনানের মাধ্যমে সাফাতের সঙ্গে আগে পরিচয় থাকলেও নাঈমকে তারা চিনতেন না। ওইদিনই নাঈমকে প্রথম দেখেছেন। ঘটনাটি জানলেও আত্মসম্মানসহ ধর্ষকদের ভয়ে শুরুতে কিছুই করতে চায়নি পরিবার। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান ধর্ষক সাফাত ও নাঈম তাদের ভিডিও প্রকাশসহ নানা ধরনের হুমকি দেয়ায় তারা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়েরে বাধ্য হন।
ওই তরুণী বলেন, খোঁজ নিয়ে জেনেছেন সাফাত ও নাঈম ইয়াবা আসক্ত। তারা গুলশান, বনানী এবং বারিধারায় বিভিন্ন হোটেলে নিরীহ তরুণীদের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে। বিশেষ করে অনেকেই বিশ্বাস করে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে যায়। সেখানে কৌশলে নেশা করিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং তার ভিডিও ধারণ করে। কোনো একপর্যায়ে সেই ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার নামে তাদের ব্ল্যাকমেইল করে। অন্যদের মতো তাদের ঘটনাটিও ছিল পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেন দুই তরুণী।
তারা বলেন, রাতের ঘটনা অন্যদের না জানানোর জন্য অস্ত্রের মুখে হুমকি দিয়েছে ধর্ষকরা। এ সময় তারা বলে, এর আগেও অনেকের সঙ্গে এ ধরনের কাজ করেছে। কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। যারা মুখ খুলেছে তাদের গুম করে দেয়া হয়েছে। তারা (দুই তরুণী) যদি মুখ খোলে বা র্যাব-পুলিশকে জানায়, তবে তাদেরও এমনই পরিণতি হবে।
এদিকে হোটেল রেইনট্রির চিফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার মো. শরীফুল আজম এলাহী বলেন, ঘটনার দিন সাফাতের জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে তারা পার্টির আয়োজন করে। ওইদিন সাফাত ও নাঈম দুটি কক্ষ বুক করে। কিন্তু সেখানে জোরপূর্বক কোনো কিছু ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। এছাড়া তারা যে ফ্লোরে কক্ষ ভাড়া নিয়েছিল সেখানে আরও তিনটি কক্ষে অতিথি ছিল। সেখানে জোরপূর্বক কিছু হলে তারা তো আমাদের কিছু বলত।
অস্ত্র নিয়ে সাফাত ও নাঈম ভেতরে প্রবেশ করেছে এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে অস্ত্র নিয়ে কেউ প্রবেশ করতে গেলে আর্চওয়ের মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়ার কথা। ওই দিন এমন কিছু ধরা পড়েনি। তিনি আরও দাবি করেন, ঘটনার পরদিন সকালে দুই তরুণী হাসিমুখে বের হয়ে গেছেন। যদি জোর করে কিছু হতো তারা হাসিমুখে বের হতেন না।
কক্ষ বুকিংয়ের সময় বিস্তারিত পরিচয় নেয়া হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা শুধু ভিজিটিং কার্ড এবং মোবাইল নম্বর রেখেই হোটেল বুকিং দেই। সেখানে সাফাতের ভিজিটিং কার্ডের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি তিনি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের ছেলে। আর নাঈম ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার ছেলে। তবে তার বিস্তারিত পরিচয় জানা নেই বলে তিনি দাবি করেন।
এ বিষয়ে সাদনান ও নাঈমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সাদনান ফোন রিসিভ করেননি। অপরদিকে নাঈমের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। শনিবার বারবার ফোন দেয়ার পরও তিনি রিসিভ করেননি।