• মঙ্গলবার , ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

আন্দোলনে যেসব সহিংসতা ঘটছে, তাতে ২০ দলীয় জোটের শরিকরা ক্ষুব্ধ


প্রকাশিত: ৮:০৭ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৫ , শনিবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৮২ বার

 

20 dal jote-www.jatirkhantha.com.bdপ্রিয়া রহমান.ঢাকা: জোটের নামে চলা আন্দোলনে যেসব সহিংসতা ঘটছে, তাতে ২০ দলীয় জোটের শরিকরা ক্ষুব্ধ। এর দায় শরিকরা বিএনপি-জামায়াতের ওপরই দিতে চাইছে।বিরোধিতার প্রশ্নে বিএনপি বাদে বাকি ১৯টি দলের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মনোভাব দিনদিন স্পষ্ট।লিয়াজোঁ কমিটির সিদ্ধান্ত আর সমর্থন ছাড়া জোটের নামে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক না হলেও ভাঙ্গনের সুর স্পষ্ঠ হয়ে উঠছে।
চলমান আন্দোলনে ২০ দলীয় জোটের আন্দোলনের সিল থাকলেও ভেতরে চলছে তুমুল বিতর্ক।আন্দোলনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়েও জোটে এখন দুটি পক্ষ বিবদমান। সমর্থন আর বিরোধিতার প্রশ্নে বিএনপি বাদে বাকি ১৯টি দলের মধ্যে পরস্পরবিরোধী মনোভাব দিনদিন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

দুই পক্ষের একটির দাবি, জোটের নামে কোনো কর্মসূচির ডাক দিলে নিয়ম অনুযায়ী আগে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে কর্মসূচি চূড়ান্ত হবে। তাতে সবার সমর্থন থাকবে। এরপরই সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি ঘোষণা হবে। অথচ চলমান আন্দোলনের বেলায় এগুলোর সবকটিই অনুপসি’ত। লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়েছে সর্বশেষ ডিসেম্বরে। আর কর্মসূচি পালন হচ্ছে বিবৃতিনির্ভর।

লিয়াজোঁ কমিটির সিদ্ধান্ত আর সমর্থন ছাড়া জোটের নামে দিনের পর দিন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ায় শরিক দল হিসেবে নিজেদের সম্মানহানি ঘটছে বলে দাবি তাদের। এমনকি তারা জানেনও না যে, একদিন পর আন্দোলনে কি যোগ হতে যাচ্ছে। জোটের শরিক দল হলেও তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না। তারা মনে করেন, সিদ্ধান্তের বেলায় সকল ক্ষমতার মালিক জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

অন্যপক্ষ বলছে, বেগম খালেদা জিয়া যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই জোটের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। এ বিষয়টি গত ডিসেম্বরের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল। সুতরাং এখন আর নতুন করে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক বা সিদ্ধান্তের দরকার নেই। এ আন্দোলনে জোটের কারো অসমর্থনের প্রশ্ন আসার কথা না।

প্রথম পক্ষ নাশকতার বিরুদ্ধে কথা বলছে। জোটের নামে চলা আন্দোলনে যেসব সহিংসতা ঘটছে, তাতে তারা ক্ষুব্ধ। এর দায় তারা বিএনপি-জামায়াতের ওপরই দিতে চাইছে। অন্যপক্ষের দাবি, নাশকতা সরকারেরই ষড়যন্ত্র। এতে ২০ দলীয় জোটের কোনো হাত নেই।

দ্বিতীয় পক্ষের এমন দাবির পর গত কয়েকদিনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স’ানে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং শিবিরের অনেক নেতাকর্মী পেট্রোলবোমাসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছেন।অন্যদিকে, পেট্রোলবোমাবাজরা কোন দলের- এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক যদিও আছে। তবে পেট্রোলবোমাবাজ যে দলেই হোক, এ মুহূর্তে বিএনপি জোটে ভাঙনের সুর বাজতে শুরু করেছে।

এর আগেও কয়েক দফা ভেঙেছে বিএনপি জোট। জোটের শরিক দল ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) গত বছরের জুনের দিকে দুই ভাগ হয়েছিল। বড় একটি অংশ জোট থেকে বেরিয়ে যায়। কাছাকাছি সময়ে আরেক শরিক দল এনডিপিও একটি অংশ নিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে পড়ে। অবশ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে এনডিপির নিবন্ধনই নেই।

এর আগেও বিএনপির অনেক নেতা দল ছেড়েছেন। তবে আন্দোলনের সময় জোটের ভেতরে চলা দ্বন্দ্ব এবারই প্রথম।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা শায়েখ আবদুল মোমিন  বলেন, ‘আমি এখন অসুস’। শারীরিকভাবে সুস’ হওয়ার পর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক আহ্বান করা হবে। তারপর জোটে থাকা বা না থাকার বিষয়ে আলোচনা হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় এসে গেছে। ২০ দলীয় জোট একসঙ্গে আন্দোলনে নামলে তা আরও বেগবান হতো। লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক এবং শরিক দলের সিদ্ধান্ত ছাড়া এখন সারা দেশে যা হচ্ছে তার নাম আন্দোলন নয়, এগুলো নাশকতা। এর দায় আমরা নিতে পারি না। কারণ, আমাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এসব হচ্ছে।’

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম চলমান আন্দোলনের সমর্থন করে বলেন, ‘আমার দল জোটের যে কোনো সিদ্ধান্তে একমত। জোটনেত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই আমাদের সবার সিদ্ধান্ত। তাতে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই।’

তবে কল্যাণ পার্টির এক জ্যেষ্ঠ নেতা  বলেন, ‘জোটে বিএনপি চেয়ারপারসনই একক সিদ্ধান্ত নেবেন- এটা হতে পারে না। শুধু আন্দোলন কেন, যে কোনো সিদ্ধান্তে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। আমরাই যদি অবমূল্যায়ন হই, তাহলে আন্দোলন কী করে হবে?’ এ নেতা আভাস দেন, জোটের ভবিষ্যৎ ভালো নয়। এমনকি তার দলেও কোন্দল শুরু হয়ে গেছে শুধু চলমান আন্দোলনে সমর্থন আর বিরোধিতার প্রশ্নে।

ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, লেবার পার্টি এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  জানান, তারা শিগগিরই একত্র হবেন। জোটের বড় একটি অংশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ চলছে। নাশকতার ঘটনা চলতে থাকায় তারা বেশ বিব্রত। এ নিয়ে তারা শিগগিরই আলোচনা করবেন। বিশেষ করে লিয়াজোঁ কমিটির সিদ্ধান্ত ব্যতীত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং তা জোটের বলে প্রচার করায় তারা বেশ ক্ষুব্ধ। মুখে না বললেও তারা জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসার পথেই হাঁটছেন- সেটি অনেকটাই স্পষ্ট।

কয়েকটি শরিক দলের এমন মনোভাব প্রসঙ্গে আলাপকালে বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘যারা এসব কথা বলছেন, তাদের নিজেদের অস্তিত্বই সংকটে। তাদের কোনো কর্মীবাহিনী নেই। কয়েকজন মিলে আর রাজনৈতিক দল পরিচালনা হয়? এগুলো একেকটি দল নামমাত্র।’ এমন দল নিয়ে জোট করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার একার সিদ্ধান্তে তো আর সব হয় না।

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘জোটে ভাঙাগড়া থাকবেই। এটি নিয়ে ভাবার সময় এখন না। এখন সবাই মিলে আন্দোলন সফল করাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে বিএনপি জোট আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে বলেও মনে হয় না। আন্দোলন থেকে পিছ পা হলে তা হবে পুরো জাতির জন্য পরাজয়।’

জোটের কয়েকটি শরিক দলের নেতাদের ভিন্ন মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ জামায়াত নেতা বলেন, ‘একেকজনের একেক মত থাকতেই পারে। তাছাড়া যেসব দল লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলছেন, তাদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ আছে।’

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্ণেল (অব.) অলি আহমদ  জানিয়েছিলেন, গত ডিসেম্বরেই চলমান আন্দোলনের প্রাথমিক আলোচনা হয়েছিল। সেদিন একটি দল ছাড়া বাকি ১৯টি দলের প্রতিনিধিরাই উপসি’ত ছিলেন। তারা আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছিলেন। এমনকি বেগম খালেদা জিয়া যখন যে সিদ্ধান্ত নেবেন, জোটের শরিক দলগুলো তাতে একমত হবেন- এটাও সেদিন সবাই মেনে নিয়েছিলেন।

জোটের ভেতরের এসব বিতর্কে বিএনপি মোটেও চিন্তিত নয় বলে জানালেন লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বড় দল বা জোটে বহু সমস্যা থাকে। এ মুহূর্তে আন্দোলনে কে সমর্থন দিল বা না দিল সেটা বড় কথা না। আন্দোলন সফল হচ্ছে এবং মনে হচ্ছে সরকার ধীরে ধীরে পিছু হটছে।’ তিনি বলেন, ‘জোট ভাঙবে না, এমনকি ভাঙলেও আগামী দিনের জন্য তা অনেক বেশি ক্ষতিকর হবে না।’

কল্যাণ পার্টির এক নেতা বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করলে বিএনপি জোট অনেক লাভবান হবে। এটি জোটের বা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্যই ইতিবাচক পরিণতি বয়ে আনবে। বিশেষ করে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে এ দলটির প্রতি সব দলের সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যেই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।’

আরেকটি শরিক দলের মহাসচিব নাশকতার দায় সরাসরি জামায়াতের ওপর দিতে চাইছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারও জানে, প্রশাসনও জানে কারা নাশকতা ঘটাচ্ছে। কারা বাসে আগুন দিচ্ছে, মানুষ পুড়িয়ে মারছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ঘটনাগুলো ঘটছে, সেখানকার প্রশাসনের নখদর্পনে খুঁটিনাটি সবগুলো বিষয় নিশ্চয়ই আছে। কিন’ রাজনৈতিক পরিসি’তির নানা হিসাব-নিকাশে অনেক অনেক কিছুই অগোচরে থেকে যাচ্ছে।’

গত বুধবার নিম্ন আদালত বেগম খালেদা জিয়ার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে নিন্দা এবং হুমকি জানানো হয়েছে। তবে জামায়াত বা ২০ দলীয় জোটের অন্য কোনো শরিক দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এটিও জোটের ভেতরে বিবদমান দূরত্বের প্রতিফলন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। কয়েকজন জোটনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বেগম জিয়ার গ্রেফতারি পরোয়ানা বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।