আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন হেলাল-তন্ময়-বিদেশে পাচার করেছে হাজার কোটি
লাবণ্য চৌধুরী : পলাতক শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই রাজনীতিবিদের আড়ালে আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন ছিলেন হেলাল-তন্ময়। তবে এলাকার লোকজন তাদের দক্ষিণাঞ্চলের ‘গডফাদার’বলেন। অনেকে বলেন এরা গডফাদারের চেয়েও বেশী। হেন কোনো অপরাধ নেইযে এরা করত না। বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল ও তার ছেলে তন্ময় জ্বালিয়ে খেয়েছে পুরো বাগেরহাট এলাকা। বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের একজন সদস্য হলেও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই হওয়ার কারণে দলে তার দাপট ছিল ব্যাপক।খুলনার গডফাদার শেখ হেলাল ও তার ছেলে সাবেক এমপি শেখ তন্ময় এখন কোথায় আছেন?
বরিশাল, খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌরুট এবং ঝিনাইদহ, যশোর, বেনাপোল সীমান্ত পথ ব্যবহার করে স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের শেল্টার দিয়ে কমিশন নিতেন তিনি। দুবাই ও সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার জুয়েলারির ব্যবসা। বিদেশে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। যে কারণে সারাবছরই তার দুবাই, সিঙ্গাপুর, কলকাতায় আসা-যাওয়া চলতো।
দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, মনোনয়ন বাণিজ্য, চাকরি, বদলি, ঠিকাদারি, ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ পাইয়ে কমিশন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু চলত শেখ হেলালের ইশারায়। দোর্দণ্ড প্রতাপ খাটিয়ে কয়েকটি জেলায় তিনি নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তার ছেলে ও সাবেক সংসদ সদস্য শেখ তন্ময়।
শেখ হাসিনার পতনের পর শুধু আওয়ামী লীগ সরকার নয়, হারিয়ে গেছে শেখ পরিবার। গত ৫ আগস্ট দুপুরে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পেয়ে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, শেখ হেলাল সরকার পতনের আগে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তিন-চার দিন আগে তড়িঘড়ি করে দেশে ফেরেন তিনি। কিন্তু সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি।তার ছেলে বাগেরহাট-২ (সদর ও কচুয়া) আসনের সাবেক এমপি তন্ময়ও আত্মগোপনে আছেন। বাগেরহাট জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন ছিলেন তন্ময়ের ডানহাত। তন্ময়ের অবৈধপথে আসা অর্থ সংগ্রহ করতেন তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) রেজোয়ান আহমেদ চয়ন, ড্যানি, বাপ্পি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান নাসিরসহ আরও কয়েকজন।
একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ সেপ্টেম্বর হেলাল ও তার ছেলে তন্ময় সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে কলকাতা চলে গেছেন।খুলনা নগরীর শেরেবাংলা রোডে এক দোতলা বাড়ির মালিক শেখ হেলাল ও তার চার ভাই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাড়িটি পরিচিতি পায় ‘শেখ বাড়ি’ হিসেবে। গত প্রায় ১৬ বছর ধরে, বিশেষ করে গত ৬ বছর ধরে বাড়িটি খুলনায় ‘ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে পরিচিত। আলোচিত সেই বাড়িটিতে ৪ আগস্ট দফায় দফায় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও বাড়ির মালামাল লুট করে বিক্ষুব্ধরা। ৫ আগস্টও ২ দফা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর বাড়িটি এখন ধ্বংসস্তূপ।
অথচ গত ১৬ বছর খুলনায় ঠিকদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়াঙ্গনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো এই বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলো এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলতো এই বাড়ির নির্দেশনায়। দলের কমিটিগুলো গঠন করে দিতেন তারাই। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা যারাই খুলনায় বদলি হয়ে আসতেন তারাই শেখ বাড়িতে এসে হাজিরা দিতেন বলে বেশ কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে।
বাগেরহাট-১ আসন থেকে শেখ হেলাল ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৯, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই পুরো সময়জুড়ে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, সেইসঙ্গে বরিশাল অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। বিশেষ করে সংসদ সদস্য মনোনয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দিতেন তিনি। খুলনা-৬ আসনে (কয়রা ও পাইকগাছা) এমপি মনোনয়ন দিতে সাবেক এমপি আক্তারুজ্জামান বাবুর কাছ থেকে নিয়েছেন ২৫ কোটি টাকা।
বরিশাল অঞ্চলের কয়েক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে দেওয়াও ছিল শেখ হেলালের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অংশ। তাদের ঠিকাদারি থেকে হেলাল ও তার ছেলে কমিশন নিতেন। কমিশন বাণিজ্যের সেই সূত্র ধরেই প্রশাসন দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতিয়ে এনে স্মাগলিং রুট নিজেদের কবজায় রাখেন শেখ হেলাল।
শেখ হেলালের ছত্রছায়ায় থাকা এইসব ব্যক্তি দক্ষিণ জনপদের এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তাদের ইশারায় চলে সেই অঞ্চলের সব অপকর্ম। তারা নৌপথে মাদক এনে দক্ষিণ অঞ্চলে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। এরমধ্যে ইয়াবা ও অস্ত্র চোরাচালান অন্যতম। এছাড়াও তারা নৌপথে কয়লা, বালু, সাপের বিষ, সোনা, চোরাচালান অপরাধে জড়িত।
জানা গেছে, স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের পাশাপাশি এই অঞ্চলে মাদক চোরাচালানে শক্ত দখল থাকায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন সম্প্রতি নিহত ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার। তার সঙ্গে চোরাচালানে জড়িত ছিলেন যশোরের শাহীন চাকলাদার। তাদেরকে শেল্টার দিতেন শেখ হেলাল। আর হেলালের অবৈধপথে আসা অর্থ সংগ্রহ করতেন তার একান্ত সহকারী ফিরোজুল ইসলাম।
পিরোজপুর-১ আসনে শ ম রেজাউল করিমকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে বিপুল অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন হেলাল ও তন্ময়। রেজাউলের বিরুদ্ধে হাজারো দুর্নীতির অভিযোগ থাকার পরও তাকে মনোনয়ন দিতে শেখ হাসিনাকে চাপ প্রয়োগ করেন হেলাল। এমনকি কমিশনের বিনিময়ে খুলনা অঞ্চলের সমস্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পালন করতেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অঢেল টাকা দিতেন শেখ হেলালকে। তিন জেলায় সরকারি দপ্তরের উচ্চ পদে বদলি হয়ে আসার জন্যও মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো তাকে। চাকরিতে নিয়োগ, সুবিধাজনক জায়গায় বদলি– সবকিছুর জন্যই দিতে হতো টাকা।
বড় বড় ঠিকাদারি কাজ কে পাবে, ব্যবসা-বাণিজ্য কে কোথায় করবে, ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোতে কে নেতা হবেন, তার সবকিছুই নির্ধারণ করে দিতেন শেখ হেলাল। তার অবৈধ সম্পদের এই সাম্রাজ্য দেখাশোনা করতেন তার পিএস, এপিএস ও সাঙ্গোপাঙ্গ।উল্লেখ্য, বর্তমানে শেখ হেলাল ও তার ছেলে শেখ তন্ময় আত্মগোপনে থাকায় তাদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাদের ব্যক্তিগত সহকারীদের মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।