অবরুদ্ধ ঈদ-স্বাধীনতার দাবিতে আত্মবিসর্জন
অনলাইন ডেস্ক : অবরুদ্ধ ঈদ-স্বাধীনতার দাবিতে আত্মবিসর্জন দিচ্ছে তাঁরা। যখন বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় ঈদুল আজহার ত্যাগের মহিমায় পশু কোরবানি দিচ্ছে, তখন অবরুদ্ধ কাশ্মিরে জনগণ স্বাধীনতার দাবিতে আত্মবিসর্জন দিয়ে পালন করছেন ঈদ।
ঈদের দিনটিতে সমগ্র উপত্যকাজুড়েই কারফিউ জারি করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঈদের জামাত। সেই সঙ্গে বন্ধ রাখা হয়েছে মোবাইল পরিষেবা। নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সিসিটিভি, হেলিকপ্টার এবং ড্রোন। ফলে উৎসবের দিনেও কার্যত গৃহবন্দি থাকতে হচ্ছে কাশ্মিরিদের।
অবরুদ্ধ ঈদ-
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “ঈদে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ বড় ধরনের সহিংসতা চালানোর চেষ্টা করবে বলে খবর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সে জন্যই আবারও কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মোবাইল পরিষেবাও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে।” কাশ্মিরের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে তিনি জানিয়েছেন।
নজরদারির জন্য হেলিকপ্টার এবং ড্রোনও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই। এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘সহিংসতা বন্ধে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এজন্য হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সার্বক্ষণিক সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ করা হবে।’ ভারতের কেন্দ্র সরকার কাশ্মিরজুড়ে সেনাবাহিনীসহ সকল নিরাপত্তাবাহিনীকে তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
ঈদে ‘আজাদি মার্চ’ ও জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকের দফতরের দিকে মিছিলের ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর জোট হুরিয়ত কনফারেন্স।
এর আগে গত সপ্তাহে হুরিয়তের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ এবং জেলা পর্যায়ের ঈদগাহে জড়ো হয়ে সবাইকে ‘আজাদি মার্চ’-এ শামিল হয়ে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকের দফতরের দিকে মিছিলের আহ্বান জানানো হচ্ছে।’
হুরিয়তের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, ‘ঈদের নামাজের আগে ইমাম এবং খতিবরা আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধিকৃত পার্টি, তাদের নেতা, নির্বাচন, নির্বাচনি প্রচারণা এবং নির্বাচনি ব্যবস্থাকে বর্জনের আহ্বান জানাবেন।’
হুরিয়ত কনফারেন্স আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হরতালের ডাক দিয়েছে। সেই সঙ্গে ভারত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ঈদ পালনেরও আহ্বান জানিয়েছে তারা।
উল্লেখ্য, ২৬ আগস্ট কারফিউ ভেঙে ‘ঈদগাহ চলো’ নামক এক সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার পর আটক করা হয় হুরিয়ত কনফারেন্সের দুই নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানি এবং মিরওয়াইজ উমর ফারুককে। গিলানিকে পরে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। তার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিরওয়াইজকে আটক রাখা হয়েছে একটি অস্থায়ী কারাগারে। হুরিয়তের আরেক অংশ জম্মু-কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ)-এর নেতা ইয়াসিন মালিক ৯ জুলাই থেকেই বন্দি রয়েছেন।
মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরে ঈদুল আযহার তিন দিন সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসে। হাজার হাজার মানুষ ঈদের নামাজ পড়েন ও নবী ইব্রাহিমের স্মরণে পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। এ বছর জনপরিসরে জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর স্পেশ্যাল ডিরেক্টর জেনারেল এস.এন শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘ছোট ছোট জমায়েতে মসজিদ বা এমন কোনও স্থানে ঈদের নামাজ পড়তে দেওয়া হতে পারে। তবে বড় কোনও মসজিদে বা ঈদগাহে জামাতে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হবে না। শ্রীনগরে সহিংসতার ইতিহাস বহু পুরনো। আর আমরা এ বিষয়ে কোনও সুযোগ দিতে চাই না।’
এ নিষিদ্ধের পক্ষে সাফাই দেন জম্মু-কাশ্মির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রবীণ নেতা মুজাফফর বেগ। তিনি বলেন, ‘অনেক মানুষের জমায়েত হবে, তাদের সবাই যে শান্ত ও স্থিরভাবে নিয়মের মধ্যে থাকবে তা নয়। কেউ হয়তো পাথর ছুড়তে শুরু করবে আর পুরো পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠবে, ফলাফল, আরও মৃত্যু।’
কিন্তু ২০১০ সালের সহিংসতার কথা উল্লেখ করে কাশ্মিরের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ঈদের নামাজ ও মোনাজাত আদায় করতে হলে তো জনপরিসরেই জমায়েত করতে হবে। জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা কী করে হবে!’
গত ৬৬ দিন ধরে কাশ্মিরে অচলাবস্থা চলছে। এর মধ্যে যে সহিংসতা ঘটেছে, তা কাশ্মিরের ইতিহাসে ভয়াবহতম। সাম্প্রতিক সহিংসতায় অন্তত ৮০ জন নাগরিকের প্রাণহানির ফলে কাশ্মির কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
অবরুদ্ধ কাশ্মির
জম্মুর পুঞ্জ জেলায় দুই পৃথক ঘটনায় পুলিশের গুলিতে অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও প্রানহানির তথ্য নিশ্চিত করে।
পুঞ্চের একটি আবাসিক বাড়ি ও এক নির্মাণাধীন সরকারি ভবনে সশস্ত্র ব্যক্তিদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানিয়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। আবাসিক বাড়ির অভিযানে কুমার নামে জম্মু-কাশ্মির পুলিশের এক কনস্টেবল নিহত হন। সেখান থেকে তিনজন এবং নির্মাণাধীন সরকারি ভবন থেকে আরও দুই জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তাবাহিনী।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ ছাড়াও আরও বেশ কিছু গ্রামে একই রকম সহিংসতা ঘটেছে। কিছু কিছু স্থানে পুলিশ স্বাধীনতার দাবি জানানো ব্যক্তিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছে।
ঈদেরও কারফিউ
রবিবার অনন্তনাগের এক গ্রামে বাসিন্দারা পুলিশের দিকে পাথর নিক্ষেপ করে। জবাবে তাদের দিকে টিয়ারগ্যাস ও ছররা গুলি নিক্ষেপ করে পুলিশ। ওই জেলার পুলিশ প্রধান রইস ভাট বলেন, ‘এই সংঘাতে অন্তত ৩৫ জন আহত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।’ তবে আহতের সংখ্যা শতাধিক বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
উপত্যকায় বিএসএনএল পোস্ট-পেড কানেকশন ছাড়া সব পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে জুলাই মাস থেকেই। প্রয়োজনে ল্যান্ডলাইনে ইন্টারনেটও বন্ধ করা হবে বলে জানিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব মেহর্ষির দাবি, ‘কাশ্মির স্বাভাবিক হচ্ছে। আমরা আশা করছি, ঈদ শান্তিতেই কাটবে।’
জাহাঙ্গীর পণ্ডিত নামের এক কাশ্মিরি বলেন, ‘কাশ্মিরে ঈদ শান্তিপূর্ণভাবে হতে পারবে কিনা তা নির্ভর করে সরকারের ওপর। তারা যদি মানুষকে ঠিকমতো নামাজ পড়তে দেয়, তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু সরকারি বাহিনী বাধা দিলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’
অগ্নিকুণ্ড কাশ্মির-
প্রসঙ্গত, ৮ জুলাই অনন্তনাগের কোকেরনাগ এলাকায় সেনা ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর যৌথ অভিযানে হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানিসহ তিন হিজবুল যোদ্ধা নিহত হন। বুরহান নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে কাশ্মির জুড়ে উত্তেজনা শুরু হয়। বিক্ষুব্ধ কাশ্মিরিদের দাবি, বুরহানকে ‘ভুয়া এনকাউন্টারে’ হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে পুলওয়ামা ও শ্রীনগরের কিছু অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়। পরবর্তীতে বিক্ষোভ আরও জোরালো হলে পুরো কাশ্মিরজুড়ে কারফিউ সম্প্রসারিত হয়।
সম্প্রতি কাশ্মিরের বেশিরভাগ এলাকা থেকে কারফিউ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও উত্তাপ কমে আসেনি। এবার আবারও স্বাধীনতার আন্দোলন দমন করতে জারি করা হলো কারফিউ। চলমান সংঘর্ষে অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজারই কাশ্মিরি বিক্ষোভকারী।সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস, ফার্স্টপোস্ট, পিটিআই।