• শনিবার , ৪ মে ২০২৪

‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ অবৈধ-হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ


প্রকাশিত: ৩:১০ এএম, ৩ জানুয়ারী ১৭ , মঙ্গলবার

নিউজটি পড়া হয়েছে ৩৩৮ বার

হাইকোর্ট রিপোর্টার  :  বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে c-h-1hhযৌথ বাহিনীর পরিচালিত অভিযান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৫২ পৃষ্ঠার এ রায়টি প্রকাশ করা হয়।

রায়ে বলা হয়, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়। সংসদকে ভুলে গেলে চলবে না যে, তাদের ক্ষমতা সংবিধানের বিধি-বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। একইভাবে যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

আদালত মনে করেন, যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না। রায়ে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর পরিচালিত অভিযানকে বৈধতা দিয়ে প্রণীত ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন ২০০৩’ বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই অভিযানের সময় যৌথ বাহিনীর কোনো সদস্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা করতে পারবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা শেষে বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর সোমবার তা প্রকাশ করা হয়। মূল রায়টি লিখেছেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। এ ছাড়া নিজস্ব অভিমত দিয়ে রায়ে একমত পোষণ করেছেন অপর বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।

রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ যথা- নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি অঙ্গই সংবিধান দ্বারা সৃষ্ট। অর্থাৎ তিনটি অঙ্গের কেউ সার্বভৌম নয়। প্রত্যেকটি অঙ্গ সংবিধানের বিধি-বিধান সাপেক্ষে স্বাধীন। শ্রেষ্ঠত্ব শুধু এ সংবিধানের। সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মানে জনগণের শ্রেষ্ঠত্ব। জনগণের অভিপ্রায় বা ইচ্ছার প্রতিফলন এই সংবিধান। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গই সংবিধানের বিধি-বিধান মেনে চলতে বাধ্য।

সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করে হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের সব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শুধু সংসদের এবং এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সংসদ স্বাধীন। তবে এ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদের কিছু সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অর্থাৎ সংসদকে আইন প্রণয়ন করতে হবে সংবিধানের ‘বিধানাবলি সাপেক্ষে’। জাতীয় সংসদ কোনোভাবেই সংবিধানের বিধানাবলির পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করবে না। সংসদ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অপরিসীম ক্ষমতাবান নয়। সংসদকে কখনোই ভুলে গেলে চলবে না যে, তাদের ক্ষমতা সংবিধানের অন্যান্য বিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ। কারণ সংবিধান লিখিত। দেশের জনগণ সবাইকেই এই সংবিধান মোতাবেক চলার নির্দেশনা দিয়েছে।

রায়ে যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রসঙ্গে বলা হয়, যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এরই মধ্যে হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, বরং সবাই আইনের অধীন। যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে যদি কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তা বেআইনি, অসাংবিধানিক ও নিন্দাযোগ্য। এ ধরনের কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন।

রায়ে আরও বলা হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে জঘন্য রূপ। সংবিধান অনুসারে একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীরও আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার অধিকার আছে। আমরা মনে করি, যৌথ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না। রায়ে বলা হয়, জাতীয় সংসদকে সতর্ক থাকতে হবে যেন এ ধরনের সংবিধানের চেতনা-পরিপন্থী আইন যেন আর প্রণীত না হয়ে যায়। ইচ্ছাধীন হত্যাকে দায়মুক্তি দিতে সংসদ কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইনটি জন্মগতভাবে মৃত এবং এর কোনো আইনগত অস্তিত্ব নেই। তবে মানুষের মৌলিক অধিকারের দিকে খেয়াল রেখে সংসদকে আইন পাস করতে হবে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে যৌথ বাহিনীর ওই অভিযান পরিচালিত হয়। এরপর ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামে ওই অভিযানের কার্যক্রমকে বৈধতা দিতে ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন, ২০০৩’ প্রণয়ন করা হয়। ২০১২ সালের ১৪ জুন ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন’ সংবিধানের সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে হাইকোর্টে একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না। রিট আবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। ওই আইনের ১৪ ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে কেউ নির্যাতিত হলে এবং এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ প্রদানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। অথচ দায়মুক্তি আইন ২০০৩-এ বলা হয়েছে, অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ কোনো আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার প্রার্থনাও করা যাবে না। এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। একই বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ক্ষতিপূরণের বিষয়ে অনেক রায় দিয়েছে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের (২০১২) ২৯ জুলাই হাইকোর্টর একটি বেঞ্চ রুল জারি করেন।

রুলে ওই আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি ওই অভিযানে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। আইন সচিব, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্র সচিব, সেনা সদর দপ্তরের কমান্ডার ইন চিফ অব আর্মড ফোর্সেস ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। ওই রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী এম মনজুর আলম।